পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে একটি নীরব বিপ্লব চলছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কৃষকরা ক্রমশ প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতি, বিশেষ করে শূন্য খরচ প্রাকৃতিক কৃষি (জেডবিএনএফ) গ্রহণ করছেন। এই পদ্ধতি কেবল খরচ কমায় না, বরং মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে, পরিবেশ রক্ষা করে এবং কৃষকদের আর্থিক স্বাধীনতা দেয়। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে এই পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক কারণ। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কেন পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা প্রাকৃতিক কৃষির দিকে ঝুঁকছেন এবং এর সুবিধা ও চ্যালেঞ্জগুলি।
1. অর্থনৈতিক সুবিধা: খরচ হ্রাস, লাভ বৃদ্ধি
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং উন্নত বীজ কেনার খরচ একটি বড় বোঝা। বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা, যারা রাজ্যের কৃষক জনসংখ্যার প্রায় ৮০% গঠন করে, প্রায়ই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। শূন্য খরচ প্রাকৃতিক কৃষি (জেডবিএনএফ) এই সমস্যার সমাধান দেয়। এই পদ্ধতিতে স্থানীয়ভাবে পাওয়া উপকরণ যেমন গোবর, গোমূত্র, গুড় এবং মটরশুটির আটা ব্যবহার করে জীবামৃত এবং বীজামৃতের মতো প্রাকৃতিক সার ও কীটনাশক তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতি উৎপাদন খরচ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে, যা কৃষকদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, নদীয়া জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন যে জেডবিএনএফ গ্রহণের পর তাদের খরচ ৪০% পর্যন্ত কমেছে, যখন ফলন স্থিতিশীল বা উন্নত হয়েছে।
2. পরিবেশগত স্থায়িত্ব: মাটি ও জল সংরক্ষণ
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গের মাটির উর্বরতা এবং জলের গুণমানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মাটি ক্রমশ অম্লীয় হয়ে পড়ছে, এবং ভূগর্ভস্থ জল নাইট্রেট দূষণের শিকার হচ্ছে। প্রাকৃতিক কৃষি মাটির জৈব পদার্থ বাড়ায় এবং মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করে। জেডবিএনএফ-এর চারটি মূল স্তম্ভ—বীজামৃত (বীজ শোধন), জীবামৃত (প্রাকৃতিক সার), মালচিং (মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ), এবং হোয়াপাসা (মাটির বায়ু সঞ্চালন)—মাটির জৈবিক কার্যকলাপ বাড়ায় এবং জল ধরে রাখার ক্ষমতা উন্নত করে। পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার মতো শুষ্ক অঞ্চলে, কৃষকরা জানিয়েছেন যে প্রাকৃতিক কৃষি তাদের ফসলের খরা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়েছে। এছাড়া, এই পদ্ধতি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমায়, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক।
3. স্বাস্থ্য সুবিধা: নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন
রাসায়নিক কৃষির ফলে উৎপন্ন খাদ্যে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ থাকায় ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। প্রাকৃতিক কৃষি রাসায়নিক-মুক্ত খাদ্য উৎপাদন করে, যা কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ের জন্যই নিরাপদ। উদাহরণস্বরূপ, হুগলি জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন যে তাদের জৈব পণ্য স্থানীয় বাজারে উচ্চ চাহিদা পাচ্ছে, কারণ ভোক্তারা স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি আগ্রহী। এছাড়া, রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের সময় কৃষকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে, যা বিশেষ করে মহিলা কৃষকদের জন্য উপকারী।
4. সরকারি ও সামাজিক সমর্থন
পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রাকৃতিক কৃষি প্রচারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা (পিকেভিওয়াই) এবং জৈব কৃষি প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় এনজিও এবং কৃষক সংগঠনগুলি, যেমন কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা, কৃষকদের জেডবিএনএফ পদ্ধতি শেখাতে কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে। এছাড়া, মহিলাদের স্ব-সহায়ক গোষ্ঠীগুলি জেডবিএনএফ-এর প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা সম্প্রদায়ের মধ্যে জ্ঞান বিনিময়কে ত্বরান্বিত করেছে। বর্ধমান জেলায়, এই গোষ্ঠীগুলি কৃষকদের মধ্যে প্রাকৃতিক কৃষির সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়েছে।
5. জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যেমন অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা এবং বন্যার সম্মুখীন। প্রাকৃতিক কৃষি ফসলের জলবায়ু সহনশীলতা বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, মালচিং এবং ফসলের বৈচিত্র্যের মতো পদ্ধতি মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং ফসলের ক্ষতি কমাতে সহায়তা করে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষকরা জানিয়েছেন যে জেডবিএনএফ পদ্ধতি গ্রহণের পর তাদের ধানের ফসল বন্যা এবং খরার সময়ে ভালো ফলন দিয়েছে।
6. চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
প্রাকৃতিক কৃষির দিকে রূপান্তর সহজ নয়। প্রথম দুই বছরে ফলন কম হতে পারে, কারণ মাটির রাসায়নিক নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে সময় লাগে। এছাড়া, কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং প্রশিক্ষণের সীমিত প্রাপ্যতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে, সরকার এবং এনজিও-র প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং কৃষকদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় এই সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম মেদিনীপুরে কৃষকরা তাদের সফল জেডবিএনএফ অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অন্যদের উৎসাহিত করছে। এছাড়া, জৈব পণ্যের জন্য বাজার সংযোগ এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া উন্নত করা প্রয়োজন, যাতে কৃষকরা তাদের পণ্যের জন্য উচ্চ মূল্য পান।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে প্রাকৃতিক কৃষি এবং শূন্য খরচ কৃষির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি একটি টেকসই এবং লাভজনক কৃষি ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত। অর্থনৈতিক সুবিধা, পরিবেশগত স্থায়িত্ব, এবং স্বাস্থ্য সুবিধার সমন্বয় এই পদ্ধতিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে, এর সফলতা নির্ভর করছে সরকারি নীতি, প্রশিক্ষণ, এবং বাজার সংযোগের উপর। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, যারা এই পরিবর্তনের পথিকৃৎ, প্রমাণ করছেন যে প্রাকৃতিক কৃষি কেবল একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, বরং একটি জীবনধারা যা পরিবেশ এবং সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাত একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।