ভারতে কৃষক আত্মহত্যা আবার কেন বাড়ছে? কৃষি ঋণের চাপ ও সংকটের গ্রাউন্ড রিপোর্ট

ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৭০% জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কৃষক আত্মহত্যার (Farmer Suicides) হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।…

Why Farmer Suicides Are Rising Again in India: A 2025 Ground Report on Agri Loan Stress and Agrarian Crisis

ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৭০% জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কৃষক আত্মহত্যার (Farmer Suicides) হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে কৃষি খাতে ১১,২৯০ জন কৃষক ও কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৩.৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও বাড়ছে বলে সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলি ইঙ্গিত দিচ্ছে। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, কর্ণাটক, এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে এই সমস্যা সবচেয়ে তীব্র। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালে কৃষক আত্মহত্যার কারণ, কৃষি ঋণের চাপ, এবং গ্রাউন্ড রিপোর্টের মাধ্যমে এই সংকটের গভীরতা বিশ্লেষণ করব।

কৃষক আত্মহত্যার প্রধান কারণ
১. ঋণের বোঝা: কৃষকদের মধ্যে ঋণের চাপ একটি প্রধান কারণ। এনসিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ৩০০০ কৃষক আত্মহত্যার মধ্যে ২৪৭৪ জনের ব্যাংক থেকে ঋণ ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, মাত্র ৯.৮% ঋণ ছিল স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে। পাঞ্জাবে ২০২০ সালে গড় কৃষক পরিবার বছরে ৩.৪৩ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়েছিল, যেখানে তাদের গড় আয় ছিল মাত্র ৩.২০ লক্ষ টাকা। উচ্চ সুদের হার (৭.৩৫% থেকে ২১%) এবং ঋণ পরিশোধের চাপ কৃষকদের মানসিক চাপ বাড়ায়।

   

২. জলবায়ু পরিবর্তন ও ফসলের ক্ষতি: জলবায়ু পরিবর্তন কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত, খরা, এবং তীব্র তাপমাত্রা ফসলের উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে মহারাষ্ট্রে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ৮ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট করেছিল। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে কৃষক আত্মহত্যা ৬৭টি বেড়ে যায়। খরার সময় এই হার ১৯% বৃদ্ধি পায়।

৩. উচ্চ উৎপাদন খরচ: বীজ, সার, কীটনাশক, এবং জ্বালানির দাম ক্রমাগত বাড়ছে। পাঞ্জাবে গম এবং ধানের উৎপাদন খরচ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮-১৯ সালে পাঞ্জাবে এক কুইন্টাল গম উৎপাদনের খরচ ছিল প্রায় ১,২৫০ টাকা, যেখানে মধ্যপ্রদেশে এটি ছিল ১,২০০ টাকা। এই উচ্চ খরচ কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

El Niño Impact on India's Paddy Farmers: Monsoon Challenges and Agricultural Concerns
El Niño Impact on India’s Paddy Farmers: Monsoon Challenges and Agricultural Concerns

৪. বাজারের অস্থিরতা: সরকারি নীতিগুলি প্রায়শই শহুরে ভোক্তাদের পক্ষে থাকে, যা কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর। ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য (এমইপি) এবং অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের মতো নীতিগুলি ফসলের দাম নিয়ন্ত্রণ করে, যা কৃষকদের আয় হ্রাস করে। এছাড়া, মধ্যস্থতাকারীদের উপস্থিতি কৃষকদের লাভের অংশ কমিয়ে দেয়।

৫. মানসিক চাপ ও সামাজিক কলঙ্ক: কৃষক আত্মহত্যার পিছনে মানসিক চাপ একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ঋণের চাপ, ফসলের ক্ষতি, এবং পারিবারিক দায়িত্ব কৃষকদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে, অনেক কৃষক পরিবার ঋণের কারণে সামাজিক বঞ্চনার সম্মুখীন হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঋণগ্রস্ত পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

২০২৫ সালের গ্রাউন্ড রিপোর্ট
২০২৫ সালে মহারাষ্ট্রের আমরাবতী বিভাগে প্রথম ছয় মাসে ৫৫৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, মাত্র তিন মাসে মহারাষ্ট্রে ৭৬৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, যদিও এই তথ্য সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। পাঞ্জাবে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ৫৫ জন কৃষক ও কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। এই ঘটনাগুলি কৃষকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশা এবং অর্থনৈতিক চাপের ইঙ্গিত দেয়।

মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এবং মারাঠওয়াড়া অঞ্চলে কৃষকরা জানিয়েছেন, খরা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত তাদের ফসল ধ্বংস করেছে। একজন কৃষক, রামেশ্বর পাটিল, জানান, “আমি ২ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়েছিলাম তুলার চাষের জন্য, কিন্তু বৃষ্টির কারণে সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ব্যাংক আমার জমি নিলাম করতে চায়।” এই ধরনের ঘটনা কৃষকদের মধ্যে হতাশা বাড়ায়।

পাঞ্জাবে কৃষক সংগঠনগুলি জানিয়েছে, সরকারি ঋণ মওকুফের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। একজন কৃষক নেতা, সরবন সিং পান্ধের, বলেন, “সরকার কৃষকদের জন্য কোনো টেকসই নীতি গ্রহণ করেনি। ঋণ মওকুফ একমাত্র সমাধান নয়, ফসলের ন্যায্য মূল্য এবং সেচ ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন।”

Advertisements

সরকারি উদ্যোগ ও ত্রুটি
সরকার বিভিন্ন সময়ে কৃষক আত্মহত্যা রোধে উদ্যোগ নিয়েছে। ২০০৮ সালের কৃষি ঋণ মওকুফ ও ঋণ ত্রাণ প্রকল্পে ৩৬ মিলিয়ন কৃষকের ৬৫,০০০ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করা হয়েছিল। মহারাষ্ট্রে ২০২২ সালে মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে ঋণ মওকুফ প্রকল্পে ৩২.১৫ লক্ষ কৃষকের ২০,৪৮৭ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করা হয়। তবে, এই প্রকল্পগুলি প্রায়শই অস্থায়ী সমাধান হিসেবে কাজ করে এবং মূল সমস্যা—যেমন ফসলের ন্যায্য মূল্য, সেচ ব্যবস্থা, এবং কৃষি বিনিয়োগের অভাব—অমীমাংসিত থেকে যায়।

প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (পিএমএফবিওয়াই) ফসলের ক্ষতি কভার করার জন্য চালু হয়েছিল, কিন্তু এটি ভাড়াটে কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করে না এবং ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া জটিল। এছাড়া, কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং ডিজিটাল বিভাজন সরকারি সুবিধা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।

সমাধানের পথ
১. টেকসই কৃষি নীতি: সরকারকে ফসলের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করতে হবে এবং মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কমাতে হবে। ই-ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল মার্কেট (ই-এনএএম)-এর মতো উদ্যোগগুলি আরও কার্যকর করা প্রয়োজন।

২. সেচ ও অবকাঠামো উন্নয়ন: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সেচ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। পাঞ্জাবে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর হ্রাস পাওয়ায় টেকসই সেচ পদ্ধতি প্রয়োজন।

৩. মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: কৃষকদের মানসিক চাপ কমাতে কাউন্সেলিং এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত। মহারাষ্ট্রের শান্তিবনের মতো উদ্যোগ, যেখানে কৃষক পরিবারের শিশুদের শিক্ষা ও সহায়তা দেওয়া হয়, আরও বাড়ানো দরকার।

৪. ঋণ পুনর্গঠন: ঋণ মওকুফের পরিবর্তে ঋণ পুনর্গঠন এবং কম সুদে ঋণ প্রদান কৃষকদের জন্য টেকসই সমাধান হতে পারে।

২০২৫ সালে ভারতে কৃষক আত্মহত্যার বৃদ্ধি একটি মানবিক সংকট। ঋণের চাপ, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং অপর্যাপ্ত সরকারি নীতি এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। কৃষকদের জন্য টেকসই সমাধান, যেমন ফসলের ন্যায্য মূল্য, উন্নত সেচ, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, জরুরি প্রয়োজন। এই সংকট সমাধানে সরকার, সমাজ, এবং কৃষক সংগঠনগুলির সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।