পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজ্যের অনেক কৃষক (Bengal Farmers) এখন ঐতিহ্যবাহী ধান চাষ ছেড়ে উচ্চমূল্যের সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং বাজার-চালিত কারণ। ধান চাষ, যা পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির মূল ভিত্তি, এখন অনেক কৃষকের কাছে কম লাভজনক হয়ে উঠেছে। উচ্চ উৎপাদন খরচ, বাজারে নিম্নমূল্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে কৃষকরা সবজি চাষের মতো বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন, যা বেশি লাভের সম্ভাবনা দেয়।
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের শীর্ষ সবজি উৎপাদনকারী রাজ্যগুলির মধ্যে একটি। বীধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুসারে, রাজ্যে প্রায় ১৩.৮০ লক্ষ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়, যার বার্ষিক উৎপাদন ২৫৫ লক্ষ টন (২০১৬-২০১৭, NHB)। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে রাজ্যের বৈচিত্র্যময় জলবায়ু, উর্বর মাটি এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলিতে কৃষি-রপ্তানি অঞ্চল (AEZ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা সবজি চাষকে বাণিজ্যিকভাবে আরও লাভজনক করে তুলেছে। বাংলাদেশ, ফিলিপাইন এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশে রাজ্যের সবজি রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কৃষকদের জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করছে।

ধান চাষের তুলনায় সবজি চাষের লাভ অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ধান চাষে প্রতি হেক্টরে গড় লাভ প্রায় ১৫,০০০ থেকে ২৬,০০০ টাকা, যেখানে সবজি চাষে, বিশেষ করে বেগুন, ফুলকপি, টমেটো এবং ভিন্ডির মতো ফসলে, প্রতি হেক্টরে লাভ ৬০,০০০ থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, সবজি চাষে বছরে একাধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব, যা কৃষকদের আয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, পয়েন্টেড গুর্ড (পটল) একটি বহুবর্ষজীবী ফসল হিসেবে পর পর দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত আয় দিতে পারে, যা ধানের তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক।
ধান চাষের ক্ষেত্রে কৃষকরা একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রথমত, ধান চাষে সেচ, সার, এবং শ্রমের খরচ বেশি। দ্বিতীয়ত, বাজারে ধানের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP) থাকলেও, অনেক কৃষক, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা, এই সুবিধা পান না। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে ধানের বাজার মূল্য প্রায় ৯৫০ টাকা প্রতি কুইন্টাল, যেখানে MSP ১,৮৬৮ টাকা। এছাড়া, বন্যা, খরা এবং মাটির উর্বরতা হ্রাসের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ধান চাষকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
অন্যদিকে, সবজি চাষে এই সমস্যাগুলি অনেকাংশে কম। সবজি চাষে জলের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম, এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতি যেমন ড্রিপ সেচ এবং ফারো-ইরিগেটেড রেইজড বেড (FIRB) ব্যবহার করে জলের ব্যবহার আরও কমানো সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, FIRB পদ্ধতি টমেটো চাষে ৩৬% জল সাশ্রয় করে এবং ফলন ৪৫ টন প্রতি হেক্টরে পৌঁছায়, যা প্রচলিত সেচ পদ্ধতির তুলনায় ৫৫% বেশি। এছাড়া, সবজি চাষে কৃষকরা স্থানীয় বাজার, কৃষক মেলা এবং রপ্তানির মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন, যা তাদের আয় বাড়ায়।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিভাগ এই পরিবর্তনকে উৎসাহিত করছে। রাজ্য সরকার হাইব্রিড সবজি বীজ এবং জৈব চাষের উপর জোর দিচ্ছে। মিদনাপুর, বীরভূম এবং বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলিতে সবজি বীজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ভর্তুকিযুক্ত বীজ ও সার সরবরাহের মাধ্যমে সরকার এই স্থানান্তরকে সমর্থন করছে। তবে, কৃষকদের মধ্যে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উচ্চমূল্যের বীজ, কীটনাশক এবং শ্রম খরচ সবজি চাষের প্রাথমিক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এছাড়া, বাজারে মধ্যস্থতাকারীদের উপস্থিতি কৃষকদের লাভের অংশ কমিয়ে দিচ্ছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সবজি চাষের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা তাদের আয় বাড়াতে পারেন, তবে এর জন্য আরও কার্যকর নীতি এবং অবকাঠামো প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, কৃষকদের জন্য সরাসরি বাজারে পৌঁছানোর সুবিধা এবং ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের ব্যবস্থা সবজি চাষকে আরও লাভজনক করতে পারে। এছাড়া, জৈব চাষ এবং হাইড্রোপনিক পদ্ধতির প্রসার কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
এই স্থানান্তর কৃষকদের জন্য শুধু আর্থিকভাবে লাভজনকই নয়, এটি পরিবেশের উপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সবজি চাষে জল এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার কম হওয়ায় মাটির উর্বরতা এবং জলের স্তর রক্ষা পাচ্ছে। ফলে, টেকসই কৃষির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ।
For more updates, follow Kolkata24x7 on Facebook, Twitter, Instagram, Youtube; join our community on Whatsapp