22% খাদ্যশস্য ফসল কাটার পর নষ্ট হয় কেন? বাংলায় কোল্ড স্টোরেজ সমস্যার বিশ্লেষণ

ভারতের কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ, তবে ফসল কাটার পরে প্রায় ২২% খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়ার কারণে এই খাতে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কৃষি…

Why 22% of India's Food Grains Are Lost: Cold Storage Issues in Bengal

ভারতের কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ, তবে ফসল কাটার পরে প্রায় ২২% খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়ার কারণে এই খাতে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১০০ বিলিয়ন টাকার খাদ্যশস্য, ফল, এবং শাকসবজি পোস্ট-হার্ভেস্ট লস বা ফসল কাটার পরের ক্ষতির কারণে নষ্ট হয়। পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে ধান, শাকসবজি, এবং ফলের মতো ফসল উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে, সেখানে কোল্ড স্টোরেজ এবং সাপ্লাই চেইনের অপ্রতুলতার কারণে এই সমস্যা বিশেষভাবে তীব্র। এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গে ফসল কাটার পরের ক্ষতির কারণ, কোল্ড স্টোরেজ সমস্যা এবং এর সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

পোস্ট-হার্ভেস্ট লসের কারণ
ফসল কাটার পরের ক্ষতি বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে, যেমন ফসল সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণ। ভারতে এই ক্ষতির প্রধান কারণগুলি হল:

   
  • অপ্রতুল কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা: পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজের অভাবে ফল, শাকসবজি এবং দুগ্ধজাত পণ্য দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদ (ICAR) অনুসারে, দেশে মোট কোল্ড স্টোরেজ ক্ষমতার মাত্র ১০% পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
  • দুর্বল সাপ্লাই চেইন: ফসল কাটার পর থেকে বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত অদক্ষ পরিবহন এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থা ক্ষতির একটি বড় কারণ। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, রেফ্রিজারেটেড পরিবহনের অভাবে শাকসবজি এবং ফল দ্রুত পচে যায়।
  • অপর্যাপ্ত অবকাঠামো: অনেক কৃষকের কাছে আধুনিক সংরক্ষণ সরঞ্জাম, যেমন প্যাকিং মেশিন বা নিয়ন্ত্রিত বায়ুমণ্ডল স্টোরেজ (Controlled Atmosphere Storage), নেই। এটি ফসলের শেলফ লাইফ কমিয়ে দেয়।
  • অজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণের অভাব: অনেক কৃষক পোস্ট-হার্ভেস্ট হ্যান্ডলিং এবং সংরক্ষণ কৌশল সম্পর্কে অবগত নন। উদাহরণস্বরূপ, ফল বা শাকসবজি সঠিকভাবে প্যাকিং না করার ফলে পরিবহনের সময় ক্ষতি হয়।
  • বাজার অ্যাক্সেসের অভাব: পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা প্রায়শই মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভর করে, যার ফলে ফসল বাজারে পৌঁছানোর সময় বিলম্ব হয় এবং নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজ সমস্যা
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ বিপুল হলেও কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার অভাব একটি প্রধান সমস্যা। রাজ্যে প্রায় ৫০০টি কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে, যা মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। ফল, শাকসবজি এবং দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা খুবই কম। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত ফল ও শাকসবজির ২৫-৩০% কোল্ড স্টোরেজের অভাবে নষ্ট হয়।

এছাড়া, কোল্ড স্টোরেজের উচ্চ ভাড়া এবং বিদ্যুৎ খরচ ছোট কৃষকদের জন্য এই সুবিধা ব্যবহার করা কঠিন করে তোলে। গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের অস্থিরতাও কোল্ড স্টোরেজের কার্যকারিতা হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং হুগলির মতো জেলায় কৃষকরা প্রায়শই তাদের ফসল স্থানীয় বাজারে দ্রুত বিক্রি করতে বাধ্য হন, যা দাম কমিয়ে দেয় এবং ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়।

Advertisements
  1. পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমানোর সমাধান
    পশ্চিমবঙ্গে পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমাতে এবং কোল্ড স্টোরেজ সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
  2. কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা সম্প্রসারণ
    সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে আরও কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা প্রয়োজন। জাতীয় উদ্যান বিভাগ (NHB) কোল্ড স্টোরেজ প্রকল্পের জন্য ৫০-৭৫% ভর্তুকি প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সুবিধা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে আরও উদ্যোগ নিতে পারে।
  3. সৌরশক্তি-চালিত কোল্ড স্টোরেজ
    বিদ্যুৎ খরচ এবং অস্থিরতার সমস্যা মোকাবিলায় সৌরশক্তি-চালিত কোল্ড স্টোরেজ একটি টেকসই সমাধান। এই ধরনের কোল্ড স্টোরেজ গ্রামীণ এলাকায় কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য হতে পারে।
  4. আধুনিক পোস্ট-হার্ভেস্ট প্রযুক্তি
    কৃষকদের আধুনিক প্যাকিং, শীতলীকরণ, এবং নিয়ন্ত্রিত বায়ুমণ্ডল স্টোরেজ কৌশল শেখানো উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ফল ও শাকসবজির জন্য প্রি-কুলিং এবং ভ্যাকুয়াম প্যাকিং ফসলের শেলফ লাইফ বাড়াতে পারে।
  5. কৃষক প্রশিক্ষণ
    পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিভাগ এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কৃষকদের জন্য পোস্ট-হার্ভেস্ট হ্যান্ডলিং এবং সংরক্ষণ কৌশলের উপর প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। এটি ফসল কাটার পরের ক্ষতি কমাতে সহায়ক হবে।
  6. রেফ্রিজারেটেড পরিবহন
    সরকারি এবং বেসরকারি খাতে রেফ্রিজারেটেড ট্রাক এবং লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। এটি ফসল বাজারে পৌঁছানোর সময় কমাবে এবং নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করবে।
  7. কৃষক সমবায় সমিতি
    কৃষকদের সমবায় সমিতির মাধ্যমে কোল্ড স্টোরেজ এবং পরিবহন সুবিধা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। এটি ছোট কৃষকদের জন্য খরচ কমাবে এবং বাজার অ্যাক্সেস বাড়াবে।
  8. ই-কমার্স এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম
    ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যেমন গ্রোফার্স বা বিগবাস্কেট, কৃষকদের সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে সহায়তা করতে পারে। এটি মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভরতা কমাবে এবং ফসলের বিলম্ব কমিয়ে আনবে।

পশ্চিমবঙ্গে সরকারি উদ্যোগ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার পোস্ট-হার্ভেস্ট লস কমানোর জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (RKVY) এবং জাতীয় উদ্যান বিভাগের মাধ্যমে কোল্ড স্টোরেজ এবং পোস্ট-হার্ভেস্ট অবকাঠামোর জন্য ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, হুগলি এবং পূর্ব মেদিনীপুরে কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে, এই উদ্যোগগুলি গ্রামীণ এলাকায় এখনও পর্যাপ্তভাবে পৌঁছায়নি।

ভারতের ২২% খাদ্যশস্য পোস্ট-হার্ভেস্ট লসের কারণে নষ্ট হওয়া খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের জীবিকার জন্য একটি বড় হুমকি। পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজ এবং সাপ্লাই চেইনের অপ্রতুলতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করছে। কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা সম্প্রসারণ, সৌরশক্তি-চালিত স্টোরেজ, আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ, এবং কৃষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ক্ষতি কমানো সম্ভব। সরকার, কৃষক সমিতি এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতকে আরও টেকসই এবং লাভজনক করে তুলতে পারে। এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করলে পশ্চিমবঙ্গ কেবল খাদ্যশস্যের ক্ষতি কমাতে পারবে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।