মাছে-ভাতে বাঙালি ভারতে মাছ উৎপাদনে প্রথম নয়

বাংলার মাছে-ভাতের প্রচলিত ছবি সত্ত্বেও অবাক করার মতো তথ্য উঠে এসেছে—ভারতের মাছ উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal Fish Production) প্রথম স্থানে নেই। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩…

Bengal Fish Farmers Battle Soaring Feed Prices in 2025: Challenges and Solutions for Aquaculture

বাংলার মাছে-ভাতের প্রচলিত ছবি সত্ত্বেও অবাক করার মতো তথ্য উঠে এসেছে—ভারতের মাছ উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal Fish Production) প্রথম স্থানে নেই। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থনৈতিক বছরে ভারতের মোট মাছ উৎপাদনের ১১.৬৬% অংশই পশ্চিমবঙ্গের অবদান, যা তাদের দ্বিতীয় স্থানে রাখে। প্রথম স্থান দখল করেছে অন্ধ্রপ্রদেশ, যার অবদান ২৯.১০%। এই তথ্যটি ইন্ডিয়ান ইনডেক্সের একটি সাম্প্রতিক পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের (MoFAH&D) তথ্যভিত্তিক। এই তথ্য প্রকাশের পর বাঙালি সমাজে বিস্ময় ও আলোচনার ঝড় বয়ে গেছে।

অন্ধ্রপ্রদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি
অন্ধ্রপ্রদেশ কীভাবে এত বড় অংশ দখল করল, তা বোঝার জন্য তাদের মাছ চাষের পদ্ধতির দিকে তাকাতে হবে। রাজ্যটি প্রধানত ভূ-ভিত্তিক (ইনল্যান্ড) মাছ চাষে নির্ভরশীল, বিশেষ করে শুঁটকি ও মাছের পোনা উৎপাদনে। নাসা এর্থ অবজার্ভেটরির একটি রিপোর্ট অনুসারে, অন্ধ্রপ্রদেশের নদী ও খালের তীরবর্তী এলাকায় ফসল চাষের জায়গা এখন মাছ ও শুঁটকি পোনার পুকুরে পরিণত হয়েছে। এই রাজ্যের শুঁটকি উৎপাদনে ভারতের ৭০% অংশ নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করে। তথ্য বলছে, ২০২০-২১ সালে মহামারীর কারণে শুঁটকি চাষে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হলেও, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা এখনও অটুট রয়েছে।

   

প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনা (PMMSY) এবং নীল বিপ্লব (Blue Revolution) প্রকল্পের মাধ্যমে অন্ধ্রপ্রদেশের মাছ চাষকাজে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। মাছের বীজ উৎপাদন ও স্টকিং ক্লাস্টার তৈরি করে তারা উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। ফলে, ১৭৫.৪৫ লক্ষ টন মাছের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের অবদান সবচেয়ে বেশি।

পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় স্থান সত্ত্বেও তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবনের মাংসল মাছ, হাওড়া ও মেদিনীপুরের নদী-জোয়ারের মাছ এবং পুষ্টিকর ইলিশ মাছের জন্য বাংলা বিখ্যাত। তবে, সামুদ্রিক মাছ চাষের তুলনায় ভূ-ভিত্তিক মাছ চাষে পশ্চিমবঙ্গ এখনও পিছিয়ে আছে। জ্যোতীশ্বর রেড্ডির একটি মন্তব্য অনুসারে, অন্ধ্রপ্রদেশের বেশিরভাগ উৎপাদন ভূ-ভিত্তিক, যা তাদের এগিয়ে রাখে।

পশ্চিমবঙ্গে মাছ চাষের উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু সুন্দরবনের জলবায়ু পরিবর্তন ও অবৈধ মাছ ধরার কারণে উৎপাদন ক্ষতি পাচ্ছে। তবে, রাজ্য সরকার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মাছ চাষে জড়িত, যা রাজ্যের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Advertisements

ভারতের মোট মাছ উৎপাদন ও বৈশ্বিক অবস্থান
ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মাছ উৎপাদক দেশ হিসেবে অবস্থান করছে, যার গ্লোবাল শেয়ার প্রায় ৮%। ভূ-ভিত্তিক মাছ চাষে ভারতের অবদান ৭৫% এর বেশি, যেখানে শুঁটকি উৎপাদনে তারা প্রথম এবং মাছ ধরার (ক্যাপচার ফিশারি) ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরকারের নীতি, যেমন জাতীয় সমুদ্রিক মাছ ধরার নীতি ২০১৭ এবং নীল বিপ্লব।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হয়েছে (২৭ জুলাই ২০২৫), যা টুনা মাছ ও গভীর সমুদ্র মাছ চাষে সহযোগিতা বাড়াবে। এই চুক্তি মাছ চাষের নতুন দিগন্ত খুলতে পারে, যা ভারতের মতো উৎপাদনশীল দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বাঙালির মাছে-ভাতের ভালোবাসা অটুট থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গকে অন্ধ্রপ্রদেশের মতো উৎপাদন বাড়াতে হলে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অবৈধ মাছ ধরা রোধ করা জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে PMMSY-এর মাধ্যমে অধিক বিনিয়োগ এবং শিক্ষাকৌশল উন্নত করলে পশ্চিমবঙ্গ আবার শীর্ষে ফিরতে পারে।

এই তথ্য মাছ চাষের ক্ষেত্রে একটি নতুন চিন্তাভাবনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাঙালি সমাজের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হলেও, সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যকে বজায় রাখা ও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। ভারতের মাছ উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা এখনও গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভবিষ্যতে তা আরও শক্তিশালী হতে পারে।