ভারতের দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal Dairy ) দেশের প্রথম দশটি রাজ্যের তালিকায় জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যা বাংলার কৃষি ও পশুপালন খাতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থনৈতিক বছরে দুধ উৎপাদনে উত্তরপ্রদেশ (১৬.২১%), রাজস্থান (১৪.৫১%), মধ্যপ্রদেশ (৮.৯১%), গুজরাট (৭.৬৫%), মহারাষ্ট্র (৬.৭১%), পঞ্জাব (৫.৮৫%), আন্ধ্রপ্রদেশ (৫.৮৫%), কর্ণাটক (৫.৬৩%), বিহার (৫.৩৭%) এবং হরিয়ানা (৫.১১%) দেশের শীর্ষ দশে রয়েছে। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম অনুপস্থিত থাকা বাংলার দুগ্ধশিল্পের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে।
দুগ্ধশিল্পে বাংলার অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের দুগ্ধশিল্প ২০২৪ সালে প্রায় ৮৯০.৪ বিলিয়ন টাকার বাজার হিসেবে গণ্য হয়, যা রাজ্যের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই খাতে উৎপাদনের পরিমাণ এবং মানের দিক থেকে বাংলা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। বাংলায় গরু ও ভেড়ার দুধ প্রধানত উৎপাদন করা হয়, তবে এই উৎপাদন স্থানীয় চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। রাজ্যের পশুপালন খাতে প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার কমতি এই পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের দাপট
উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের দুধ উৎপাদনে অগ্রগতি লক্ষণীয়। উত্তরপ্রদেশের ১৬.২১% অংশ এবং রাজস্থানের ১৪.৫১% অংশ দুধ উৎপাদনে দেশের মোট উৎপাদনের এক বড় অংশ নিজেদের নামে করে। রাজস্থানের মতো শুষ্ক এবং উর্বরহীন ভূমি থাকা সত্ত্বেও উট ও ছাগলের দুধ উৎপাদনে তাদের সাফল্য বিস্ময়কর। অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশে পশুপালনের জন্য সরকারি উৎসাহনা এবং দুগ্ধশিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এই রাজ্যকে শীর্ষে রাখে। এই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনো বড় প্রকল্প বা নীতি এখনো পর্যন্ত গুরুত্ব পায়নি।
বাংলায় সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গে দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। রাজ্যের উর্বর জমি এবং গ্রামীণ অঞ্চলে পশুপালনের ঐতিহ্য এই খাতে উন্নতির পথ খুলে দিতে পারে। তবে, কৃষকদের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ, পশুর খাদ্য সরবরাহে উন্নতি এবং বাজারে উৎপাদিত দুধের বিক্রয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার দরকার। বর্তমানে বাংলায় দুধের চাহিদা বাড়ছে, বিশেষ করে শহরে যোগার্ট, পনির এবং প্রোবায়োটিক পানীয়ের জন্য। তবে, এই চাহিদা পূরণে স্থানীয় উৎপাদন ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে রাজ্য বাইরে থেকে দুধ আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজন
পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার। দুগ্ধশিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং পশুপালনের জন্য সহজে উপলব্ধ ঋণ সুবিধা প্রদান করা জরুরি। উত্তরপ্রদেশের মতো ২০২২ সালের দুগ্ধ উন্নয়ন নীতি বা রাজস্থানের সহযোগী দুগ্ধ ফেডারেশনের মতো মডেল বাংলায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া, সরকারকে বাজারে সরাসরি দুধ বিক্রয়ের জন্য সহযোগী সমিতি গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে, যা কৃষকদের আর্থিক সুবিধা দেবে।
উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির ভূমিকা
আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন কৃত্রিম গর্ভাবস্থা এবং উন্নত জাতের গরু-ভেড়া প্রজনন, দুধ উৎপাদনে বৃদ্ধি আনতে পারে। ইসরোর মতো প্রযুক্তি সংস্থা যেভাবে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করছে, তেমনভাবে দুগ্ধশিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য একটি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এছাড়া, দুগ্ধশিল্পে যুবশক্তিকে আকর্ষণ করতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের দুগ্ধশিল্পকে উন্নত করা একটি জরুরি প্রয়োজন। দেশের শীর্ষ দশে জায়গা করে নেওয়া এখনো সম্ভব, তবে তা জন্য সরকার, কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যদি সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবে বাংলা দুগ্ধশিল্পে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।