West Bengal Drone Farming: পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে ২০২৫ সালে একটি নতুন বিপ্লব শুরু হয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ড্রোন প্রযুক্তি। ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদের পদ্ধতি থেকে সরে এসে, রাজ্যের কৃষকরা এখন ড্রোন ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছেন, খরচ কমাচ্ছেন এবং পরিবেশ-বান্ধব কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ড্রোন প্রযুক্তি গ্রহণ করছেন, এর সুবিধা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
ড্রোন প্রযুক্তির কৃষিতে প্রয়োগ
ড্রোন প্রযুক্তি, যা ইউএভি (Unmanned Aerial Vehicles) নামেও পরিচিত, কৃষিতে একাধিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ড্রোন ব্যবহার করছেন ফসল পর্যবেক্ষণ, মাটির বিশ্লেষণ, কীটনাশক ও সার ছিটানো, এবং সেচ ব্যবস্থাপনার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার স্কাইগ্লিম্পস টেকনোলজিসের মতো সংস্থাগুলো কৃষকদের জন্য ড্রোন ম্যাপিং এবং ফসল স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের পরিষেবা প্রদান করছে। এই ড্রোনগুলো উচ্চ-রেজোলিউশন ক্যামেরা, তাপীয় সেন্সর এবং জিপিএস প্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত, যা কৃষকদের ফসলের স্বাস্থ্য, পানির অভাব, বা কীটপতঙ্গের আক্রমণ সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্য প্রদান করে।
পশ্চিমবঙ্গে ড্রোন গ্রহণের প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে শ্রমিকের অভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো ড্রোন প্রযুক্তির গ্রহণকে ত্বরান্বিত করেছে। ২০২৩ সালে বিকশিত ভারত সংকল্প যাত্রা (VBSY) ইভেন্টে কলকাতায় ড্রোন প্রযুক্তির লাইভ প্রদর্শনী কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। এই প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে ড্রোন কীটনাশক ছিটানোর কাজ মাত্র ৫-৭ মিনিটে এক একর জমিতে সম্পন্ন করতে পারে, যা হাতে-কলমে কাজের তুলনায় অনেক দ্রুত এবং কার্যকর।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ড্রোন প্রযুক্তির প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘পশ্চিমবঙ্গ ড্রোন প্রযুক্তি প্রচার নির্দেশিকা’ এর মাধ্যমে রাজ্য সরকার কৃষি, পরিকাঠামো এবং নজরদারি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহারের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করেছে। এছাড়া, ২০২৫ সালে বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট (BGBS)-এর আগে রাজ্য সরকার ড্রোন নীতি আপডেট করার পরিকল্পনা করছে, যাতে আরও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়।
মহিলা কৃষকদের ক্ষমতায়ন
পশ্চিমবঙ্গে ‘নমো ড্রোন দিদি’ প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী (SHGs) ড্রোন প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ২০২৪-২৫ থেকে ২০২৫-২৬ পর্যন্ত ১৫,০০০ মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ড্রোন প্রদান করা, যাতে তারা কৃষকদের জন্য ভাড়ার ভিত্তিতে কৃষি পরিষেবা প্রদান করতে পারে। এই উদ্যোগ প্রতিটি গোষ্ঠীর জন্য বছরে কমপক্ষে ১ লক্ষ টাকার অতিরিক্ত আয়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মহিলারা এখন ড্রোন পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষিত হচ্ছেন, যা তাঁদের আর্থিক স্বাধীনতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
ড্রোন প্রযুক্তির সুবিধা
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ড্রোন প্রযুক্তি থেকে একাধিক সুবিধা পাচ্ছেন। প্রথমত, ড্রোন কীটনাশক এবং সারের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত করে, যা রাসায়নিকের অপচয় কমায় এবং পরিবেশের উপর প্রভাব হ্রাস করে। দ্বিতীয়ত, ড্রোন দিয়ে বড় জমির দ্রুত পর্যবেক্ষণ সম্ভব, যা শ্রম এবং সময় বাঁচায়। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবে ড্রোন ব্যবহার করে কৃষকরা এক একর জমিতে ৫-৭ মিনিটে কীটনাশক ছিটাতে পারেন, এবং এই প্রযুক্তি এখন পশ্চিমবঙ্গেও জনপ্রিয় হচ্ছে।
তৃতীয়ত, ড্রোনের মাধ্যমে ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং রোগ সনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে। মাল্টিস্পেকট্রাল এবং তাপীয় সেন্সর দিয়ে সজ্জিত ড্রোনগুলো জমির পানির অভাব, পুষ্টির ঘাটতি, বা কীটপতঙ্গের আক্রমণ চিহ্নিত করতে পারে। এই তথ্য কৃষকদের সময়মতো ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করে, যা ফলন ১৫-৩৫% পর্যন্ত বাড়াতে পারে। এছাড়া, ড্রোন ব্যবহারে কৃষকদের কীটনাশকের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি কমছে, যা তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়ক।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
ড্রোন প্রযুক্তির গ্রহণ সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ড্রোনের উচ্চ মূল্য (৪-১৬ লক্ষ টাকা) এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ছোট কৃষকদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া, ড্রোন পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব অনেক কৃষকের জন্য সমস্যা। তবে, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, যেমন ‘নমো ড্রোন দিদি’ এবং উৎপাদন-সংযুক্ত প্রণোদনা (PLI) প্রকল্প, কৃষকদের জন্য ড্রোন ক্রয়ে ৮০% পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদান করছে।
এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গ ড্রোন সেন্টার অফ এক্সিলেন্স (WBDCoE) এবং আইআইটি-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ কৃষকদের ড্রোন পরিচালনা, ডেটা বিশ্লেষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ করে তুলছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গে ড্রোন প্রযুক্তির গ্রহণ কৃষি খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা করছে। রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ড্রোন উৎপাদন এবং গবেষণার জন্য আরও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হবে। কলকাতায় প্রস্তাবিত সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট এবং ড্রোন হাব এই প্রযুক্তির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং-এর সঙ্গে ড্রোন প্রযুক্তির সমন্বয় কৃষকদের আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করছে, যা ফসলের রোগ সনাক্তকরণ এবং ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ২০২৫ সালে ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি খাতে একটি বড় পরিবর্তন আনছেন। সরকারি নীতি, ভর্তুকি, এবং প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য হচ্ছে। ড্রোনের ব্যবহার কৃষকদের সময়, খরচ এবং শ্রম বাঁচাচ্ছে, এবং ফসলের ফলন ও গুণমান বাড়াচ্ছে। যদিও উচ্চ খরচ এবং প্রশিক্ষণের অভাবের মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বাধাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও স্মার্ট এবং টেকসই কৃষির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা রাজ্যের অর্থনীতি এবং কৃষি খাতের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্দেশ করছে।