ভার্মিকম্পোস্টের বিপ্লব! গাজীপুরের কৃষকদের জৈব সারে নতুন আশা

Vermicompost Revolution: কৃষি ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এবং সার এই খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু রাসায়নিক সারের ক্রমবর্ধমান দাম এবং মাটির উর্বরতা হ্রাস কৃষকদের জন্য একটি…

Vermicompost

Vermicompost Revolution: কৃষি ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এবং সার এই খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু রাসায়নিক সারের ক্রমবর্ধমান দাম এবং মাটির উর্বরতা হ্রাস কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন গাজীপুরের কৃষকরা। তারা জৈব সার, বিশেষ করে ভার্মিকম্পোস্টের দিকে ঝুঁকছেন, যা তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। গরুর গোবর, পাতা এবং রান্নাঘরের বর্জ্যের মতো জৈব উপাদান থেকে কেঁচোর সাহায্যে তৈরি এই সার কৃষিকে টেকসই এবং লাভজনক করে তুলছে। এই প্রতিবেদনে আমরা গাজীপুরের কৃষকদের এই নতুন উদ্যোগ, ভার্মিকম্পোস্টের উপকারিতা এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।

ভার্মিকম্পোস্ট: কী এবং কেন?
ভার্মিকম্পোস্ট হল কেঁচোর সাহায্যে তৈরি একটি জৈব সার, যা গরুর গোবর, পাতা, ফসলের অবশিষ্টাংশ এবং রান্নাঘরের বর্জ্যের মতো জৈব উপাদান পচিয়ে তৈরি করা হয়। কেঁচো এই উপাদানগুলো খেয়ে তাদের মলমূত্রের মাধ্যমে একটি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সার উৎপন্ন করে, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং ফসলের গুণমান উন্নত করে। গাজীপুরের ভানওয়ারকোল ব্লকের কৃষকরা এই সার তৈরিতে ব্যাপকভাবে জড়িত হয়েছেন। তারা দেখেছেন যে ভার্মিকম্পোস্ট শুধুমাত্র রাসায়নিক সারের বিকল্প নয়, বরং এটি মাটির দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।

   

কৃষক রামবৃক্ষ যাদব, যিনি গত পাঁচ বছর ধরে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করছেন, বলেন, “আগে আমরা প্রতি মৌসুমে ৬-৭ ব্যাগ ইউরিয়া ব্যবহার করতাম। এখন ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করে আমরা অর্ধেক পরিমাণে সার দিয়েই ভালো ফসল পাচ্ছি। ফসলের গুণমানও ভালো হচ্ছে, এবং মাটি সুস্থ থাকছে।” তিনি আরও বলেন, ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ কম, এবং এটি তাদের খরচ অনেকাংশে কমিয়েছে।

ভার্মিকম্পোস্টের উপকারিতা
গাজীপুর কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ ড. সিং ব্যাখ্যা করেন, “ভার্মিকম্পোস্ট মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, যা খরা প্রবণ এলাকায় বিশেষভাবে উপকারী। এটি মাটির জৈব উপাদান বাড়ায়, যা উদ্ভিদের পুষ্টি গ্রহণে সহায়তা করে।” তিনি আরও বলেন, “প্রতি বছর ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসে, যার ফলে সারের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। শস্য ফসলের জন্য প্রতি হেক্টরে ৩ থেকে ৪ টন ভার্মিকম্পোস্ট যথেষ্ট।”

Vermicompost

ভার্মিকম্পোস্টের আরেকটি বড় সুবিধা হল এর টেকসইতা। রাসায়নিক সার মাটির অণুজীবের ক্ষতি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে। অন্যদিকে, ভার্মিকম্পোস্ট মাটির জৈব কাঠামো উন্নত করে এবং ফসলের স্বাদ ও গুণমান বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, গাজীপুরের কৃষকরা জানিয়েছেন যে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারের ফলে তাদের শাকসবজি এবং ধানের ফসলের বাজার মূল্য বেড়েছে। এছাড়া, এই সার পরিবেশবান্ধব, কারণ এটি জৈব বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, যা পরিবেশ দূষণ কমায়।

সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি
ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকার জৈব কৃষিকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে। গাজীপুরে কৃষকরা ভার্মিকম্পোস্ট পিট তৈরির জন্য ভর্তুকি পাচ্ছেন। জাতীয় কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাংক (নাবার্ড) এবং কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। এই প্রশিক্ষণে কৃষকরা শিখছেন কীভাবে কেঁচোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হয় এবং কীভাবে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি ও সংরক্ষণ করতে হয়।

Advertisements

একজন কৃষক, শ্যামলাল সিং, বলেন, “আমরা দুটি গরু পালন করি এবং একটি ছোট ভার্মি পিট তৈরি করেছি। এখন আমাদের সারের জন্য বাজারের উপর নির্ভর করতে হয় না। এটি আমাদের খরচ কমিয়েছে এবং ফসলের উৎপাদন বেড়েছে।” তিনি আরও বলেন, সরকারের ভর্তুকির মাধ্যমে তিনি মাত্র ৫০০০ টাকায় একটি ভার্মি পিট তৈরি করেছেন, যা তিন মাসের মধ্যে লাভ দিতে শুরু করেছে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির প্রক্রিয়া সহজ হলেও এর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, কেঁচোর জন্য সঠিক তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বজায় রাখা প্রয়োজন। গাজীপুরের মতো উষ্ণ জলবায়ুতে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের মধ্যে জৈব সার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকে এখনো রাসায়নিক সারের উপর নির্ভর করেন, কারণ তারা ভার্মিকম্পোস্টের দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা সম্পর্কে জানেন না।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং স্থানীয় এনজিও-রা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তারা কৃষকদের শিখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে কম খরচে ভার্মি পিট তৈরি করা যায় এবং কেঁচোর যত্ন নেওয়া যায়। এছাড়া, সরকারি ভর্তুকি এবং স্বল্প সুদে ঋণ কৃষকদের জন্য এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
গাজীপুরের কৃষকদের এই উদ্যোগ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের জন্য একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে। ভার্মিকম্পোস্ট শুধুমাত্র মাটির উর্বরতা বাড়ায় না, বরং কৃষকদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে। এটি পরিবেশ দূষণ কমায় এবং জৈব বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের একটি কার্যকর উপায়। গাজীপুরের কৃষকরা প্রমাণ করেছেন যে কম খরচে এবং স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে কৃষি টেকসই করা সম্ভব।

ভার্মিকম্পোস্ট গাজীপুরের কৃষকদের জন্য একটি নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে। এটি শুধুমাত্র রাসায়নিক সারের নির্ভরতা কমায়নি, বরং মাটির স্বাস্থ্য এবং ফসলের গুণমান উন্নত করেছে। সরকারি সহায়তা এবং কৃষকদের উদ্যোগের মাধ্যমে ভার্মিকম্পোস্ট ভারতীয় কৃষিতে একটি বিপ্লব আনতে পারে।