Turn Waste into Gold: ভারতের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে টেকসই পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ভার্মিকম্পোস্টিং বা কেঁচো সার তৈরি একটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভার্মিকম্পোস্ট (Vermicomposting) হলো কেঁচোর মাধ্যমে জৈব বর্জ্য থেকে তৈরি একটি পুষ্টিকর জৈব সার, যা ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে। ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬২ মিলিয়ন টন জৈব বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার একটি বড় অংশ ভার্মিকম্পোস্টে রূপান্তরিত হতে পারে। এই প্রক্রিয়া কেবল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে না, বরং কৃষক ও গৃহস্থালির জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে। এই নিবন্ধে আমরা ঘরে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির সহজ পদ্ধতি, এর সুবিধা এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
ভার্মিকম্পোস্টিং কী এবং এর সুবিধা
ভার্মিকম্পোস্টিং হলো কেঁচো ব্যবহার করে রান্নাঘরের বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য, এবং জৈব পদার্থকে পুষ্টিকর সারে রূপান্তর করার একটি প্রক্রিয়া। এই সারে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং অনুপুষ্টি (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস) থাকে, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং ফসলের ফলন ২০-৩০% বৃদ্ধি করে। ভার্মিকম্পোস্ট রাসায়নিক সারের তুলনায় পরিবেশবান্ধব এবং মাটির গঠন উন্নত করে।
ভার্মিকম্পোস্টিংয়ের প্রধান সুবিধাগুলো হলো:
১. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: রান্নাঘরের বর্জ্য, শাকসবজির খোসা, এবং পাতা থেকে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করে বর্জ্য নিষ্কাশনের পরিমাণ ৬০% পর্যন্ত কমানো যায়।
২. কম খরচে উৎপাদন: একটি ছোট ভার্মিকম্পোস্ট ইউনিট স্থাপনে মাত্র ৫,০০০-১০,০০০ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।
৩. অতিরিক্ত আয়: ভার্মিকম্পোস্টের বাজার মূল্য প্রতি কেজি ১৫-৩০ টাকা, এবং একটি ছোট ইউনিট থেকে মাসে ১০,০০০-২০,০০০ টাকা আয় সম্ভব।
৪. পরিবেশ সুরক্ষা: এটি রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করে।

ঘরে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির সহজ পদক্ষেপ
১. প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান অর্জন: ভার্মিকম্পোস্টিং শুরু করার আগে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত। এই প্রশিক্ষণে কেঁচো নির্বাচন, বেড তৈরি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে শেখানো হয়।
২. উপযুক্ত কেঁচো নির্বাচন: ভারতে Eisenia fetida এবং Eudrilus eugeniae প্রজাতির কেঁচো ভার্মিকম্পোস্টিংয়ের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এই কেঁচোগুলো দ্রুত জৈব পদার্থ ভেঙে ফেলে এবং প্রজনন ক্ষমতা বেশি।
৩. বেড তৈরি: একটি প্লাস্টিকের ট্রে, কাঠের বাক্স, বা সিমেন্টের ট্যাঙ্কে ভার্মিকম্পোস্ট বেড তৈরি করা যায়। বেডে খড়, শুকনো পাতা, গোবর, এবং রান্নাঘরের জৈব বর্জ্য মেশানো হয়। বেডের আর্দ্রতা ৬০-৭০% এবং তাপমাত্রা ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে হয়।
৪. কেঁচো প্রবেশ ও রক্ষণাবেক্ষণ: প্রতি বর্গমিটারে ১ কেজি কেঁচো ছাড়তে হয়। নিয়মিত জল ছিটিয়ে আর্দ্রতা বজায় রাখতে হয় এবং বেডকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করতে হয়। ৬০-৯০ দিনে কেঁচো জৈব পদার্থকে কালো, দানাদার সারে রূপান্তরিত করে।
৫. ফসল কাটা ও বাজারজাতকরণ: ভার্মিকম্পোস্ট প্রস্তুত হলে এটি ছেঁকে আলাদা করা হয়। এটি স্থানীয় কৃষক, নার্সারি, বা জৈব কৃষি পণ্যের দোকানে বিক্রি করা যায়। অ্যাগ্রিটেক প্ল্যাটফর্ম যেমন ডিহাট বা অ্যাগ্রোস্টার ভার্মিকম্পোস্ট বিক্রির জন্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস সরবরাহ করে।
সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ
ভারত সরকারের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ এবং ‘জৈব কৃষি মিশন’র অধীনে ভার্মিকম্পোস্টিংয়ের জন্য ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় জৈব কৃষি কেন্দ্র (NCOF) এবং রাজ্য সরকারগুলো কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ এবং কেঁচো সরবরাহ করে। পশ্চিমবঙ্গে, কৃষি বিভাগ ভার্মিকম্পোস্ট ইউনিট স্থাপনে ৫০-৭৫% ভর্তুকি দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্ধমান ও হুগলি জেলায় কৃষকরা ভার্মিকম্পোস্ট বিক্রি করে বছরে ১-২ লক্ষ টাকা আয় করছেন।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
ভার্মিকম্পোস্টিংয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা, কেঁচোর রোগ, এবং বাজার অ্যাক্সেস। অনেক কৃষক প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবে ব্যর্থ হন। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ পরিষেবা দিচ্ছে। এছাড়া, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় সমবায় সমিতিগুলো ভার্মিকম্পোস্টের বাজারজাতকরণে সহায়তা করছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ভারতে জৈব কৃষির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, যেখানে ভোক্তারা জৈব পণ্যের জন্য বেশি মূল্য দিতে প্রস্তুত। ভার্মিকম্পোস্টের বাজার ২০২৭ সালের মধ্যে ১০,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, এবং দার্জিলিং জেলায় ভার্মিকম্পোস্টিং জনপ্রিয় হচ্ছে, যেখানে কৃষকরা জৈব কৃষির জন্য এই সার ব্যবহার করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে, জৈব সারের চাহিদা বাড়ছে, যা ভার্মিকম্পোস্ট রপ্তানির সুযোগ তৈরি করছে।
ভার্মিকম্পোস্টিং একটি সহজ, কম খরচের, এবং টেকসই উদ্যোগ, যা ঘরে বসে জৈব বর্জ্য থেকে পুষ্টিকর সার তৈরি করে। এটি কৃষক, গৃহিণী এবং উদ্যোক্তাদের জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে এবং পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখে। সরকারি ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ, এবং অ্যাগ্রিটেক প্ল্যাটফর্মের সহায়তায় ভার্মিকম্পোস্টিং ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। যারা বর্জ্যকে সোনায় রূপান্তর করতে চান, তাদের জন্য এখনই সময় ভার্মিকম্পোস্টিং শুরু করার।