কৃষির সৌজন্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কোটি কোটি টাকা আসছে ত্রিপুরায়

ত্রিপুরা, (Tripura) উত্তর পূর্ব ভারতের একটি ছোট্ট রাজ্য। দেশের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম বাংলাদেশ লাগোয়া এই রাজ্যে পর্যটন এবং কৃষির উপর ভিত্তি করেই চলছে সংসার, ভরছে মানুষের…

Tripura agriculture growth

ত্রিপুরা, (Tripura) উত্তর পূর্ব ভারতের একটি ছোট্ট রাজ্য। দেশের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম বাংলাদেশ লাগোয়া এই রাজ্যে পর্যটন এবং কৃষির উপর ভিত্তি করেই চলছে সংসার, ভরছে মানুষের পকেট। কিন্তু শুধু কৃষি এবং পর্যটনের উপর ভিত্তি করেই তো আর শুধু রাজ্যের উন্নতি সম্ভব নয়। তার সঙ্গে দরকার কৃষিজাত দ্রব্যের রফতানি।

বিদেশে কৃষিজাত দ্রব্যের রফতানি বাড়াতে পারে রোজগার।আর রোজগার বাড়লে উন্নত হবে রাজ্যের মানুষের জীবনযাত্রার মান। ঠিক সেই কারণেই ত্রিপুরা (Tripura) সরকারের প্রত্যয়ী মনোভাবে এই রাজ্যের জায়গা হয়েছে সুদূর মধ্য প্রাচ্যের হৃদয়ে।

   

শুধু মাত্র আনারস রফতানি করেই মধ্য প্রাচ্য থেকে দেশে আসছে কোটি কোটি টাকা। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের ব্যাবসায়িক বছরে ভারত বিদেশে রফতানিতে রেকর্ড করে। যার মধ্যে একটি প্রধান ভূমিকায় ছিল ত্রিপুরার আনারস। সেই বছরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মন কি বাত এ এই রেকর্ড এবং তাতে ত্রিপুরার আনারসের ভূমিকা তুলে ধরেন।

আনারস রপ্তানির সাফল্য

ত্রিপুরার (Tripura) কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রী রতন লাল নাথ উনাকোটি জেলার কুমারঘাটে গীতাঞ্জলি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত রাজ্য-স্তরের আনারস উৎসবে ঘোষণা করেন যে, গত সাত বছরে (২০১৮-২০২৫) ত্রিপুরা ৭৩.১৫ মেট্রিক টন আনারস দুবাই, ওমান এবং কাতারে রফতানি করেছে। এই ঘোষণা ত্রিপুরার কৃষি খাতের ক্রমবর্ধমান সাফল্যের প্রমাণ।

মন্ত্রী জানান, রাজ্য সরকার কৃষিজাত পণ্যের রফতানি বাড়ানো এবং কৃষকদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “আমাদের সরকার কুইন আনারসকে রাজ্যের ফল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি ইতিমধ্যে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) ট্যাগ পেয়েছে, যা এর অনন্য পরিচিতি রক্ষা করে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এটিকে একটি বিশেষ পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে।”

কুইন আনারসের বিশ্বজয়

ত্রিপুরার (Tripura) কুইন ও কিউ জাতের আনারস রাজ্যের পাহাড়ি ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে স্বল্প রাসায়নিক ব্যবহারে উৎপন্ন হয়। এই আনারসগুলি সোনালি হলুদ রঙের, যা পাকলে স্বাদে এবং গন্ধে অতুলনীয়। ২০১৮ সালে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ কুইন আনারসকে ত্রিপুরার রাজ্য ফল হিসেবে ঘোষণা করেন, যা এর গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

এই জাতের আনারসের কম অম্লতা এবং প্রাকৃতিক মিষ্টতা এটিকে প্রিমিয়াম জুস ও ডেজার্ট তৈরির জন্য আদর্শ করে তুলেছে। মন্ত্রী নাথ জানান, ২০১৮ সালে একটি আনারসের দাম ছিল ৮-৯ টাকা, যা এখন বেড়ে ৪০ টাকা বা তার বেশি হয়েছে। এই দাম বৃদ্ধি কৃষকদের আয় বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি ও অর্থনৈতিক প্রভাব

২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভারতের কৃষিজাত পণ্যের রফতানি রেকর্ড সৃষ্টি করে, এবং ত্রিপুরার (Tripura) আনারস এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে ত্রিপুরার আনারসের রফতানি সাফল্যের প্রশংসা করেন। গত সাত বছরে ত্রিপুরা ৭৩.১৫ মেট্রিক টন আনারস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে রফতানি করেছে, যা কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে সম্ভব হয়েছে।

২০২৪ সালে ৬০০ কেজি কুইন আনারস ওমানে পাঠানো হয়, ৫ মেট্রিক টন দুবাইয়ে এবং ৩০ মেট্রিক টন হল্যান্ডে রফতানির পরিকল্পনা চলছে। এছাড়া, ২০২২ সালে ত্রিপুরা ৯,৯০৯ টন আনারস রপ্তানি করে ১৪ কোটি টাকার বাণিজ্য করে।

Advertisements

অন্যান্য কৃষিপণ্যের রপ্তানি

আনারস ছাড়াও ত্রিপুরা ২০১৮-২০২৫ সালের মধ্যে ৪.৪০ মেট্রিক টন কাঁঠাল আমেরিকায়, ৩০ মেট্রিক টন আদা এবং ১৭ মেট্রিক টন পান পাতা বাংলাদেশে রফতানি করেছে। এছাড়া, ২৫৭ মেট্রিক টন তেঁতুল, ৩৯৭ মেট্রিক টন তেঁতুল এবং ৭৪ মেট্রিক টন আদা বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে। এই রফতানি কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং রাজ্যের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সহায়ক হয়েছে।

জিআই ট্যাগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

কুইন আনারস ২০১৫ সালে জিআই ট্যাগ পায়, যা এর অনন্য গুণমান ও পরিচিতিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করেছে। ত্রিপুরা সরকার (Tripura) এখন সিদোল শুটকি (গাঁজানো মাছ) এবং সাবরি কলার জন্যও জিআই ট্যাগ পাওয়ার জন্য কাজ করছে।

মন্ত্রী নাথ জানান, কেন্দ্রীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রণালয় (DoNER) এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার সঙ্গে সহযোগিতায় ১৩২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা কুইন আনারসকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এছাড়া, ধলাই জেলার নলকাটায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে একটি ফল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

কেরলের শিক্ষা ব্যাবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনে উধাও হবে লাস্ট বেঞ্চ

জৈব কৃষি ও বাজার সম্প্রসারণ (Tripura) 

ত্রিপুরা (Tripura) ২৫,০০০ হেক্টরেরও বেশি জমিকে জৈব চাষের জন্য প্রত্যয়িত করেছে। গত তিন বছরে ১,৩৩২ মেট্রিক টন জৈব পণ্য রফতানি করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬৬৬ মেট্রিক টন আনারস, ৫৭৪ মেট্রিক টন আদা, ৫২ মেট্রিক টন হলুদ, ৩৩ মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল এবং ৭ মেট্রিক টন লঙ্কা রয়েছে।

এই পণ্যগুলি দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, কলকাতা, গুয়াহাটি এবং দুবাই, ওমান ও ঢাকায় রপ্তানি হয়েছে। রাজ্য সরকার জৈব পণ্যের প্রচারের জন্য প্রথমবারের মতো ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মেলন আয়োজন করেছে।

ত্রিপুরার (Tripura) কুইন আনারস শুধু রাজ্যের কৃষকদের আয়ই বাড়ায়নি, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে রাজ্যের পরিচিতি বাড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আনারস রপ্তানির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য এবং অন্যান্য কৃষিপণ্যের রফতানি ত্রিপুরার অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সরকারের জৈব কৃষি ও রফতানি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা, জিআই ট্যাগ এবং প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা ত্রিপুরাকে ভারতের কৃষি মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল নাম করে তুলছে।