উত্তরবঙ্গের (North Bengal) আদিবাসী কৃষকরা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে ভুলে যাওয়া মিলেট বা কোডো-কুটকির চাষ পুনরুজ্জীবনের এক অসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছেন। এই প্রাচীন শস্য, যা একসময় এই অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাসের একটি প্রধান অংশ ছিল, গত কয়েক দশকে ধান ও গমের আধিপত্য এবং বাণিজ্যিক ফসলের প্রভাবে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর খাদ্যশস্যের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণে এই মিলেটগুলো আবারও কৃষকদের ক্ষেতে ফিরে আসছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সম্প্রদায়, বিশেষ করে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারের মতো জেলাগুলোতে, এই মিলেট পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে তাঁদের সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে পুনরুদ্ধার করছে।
মিলেট, যেমন কোডো (মারভা), কুটকি, রাগি এবং ফক্সটেল মিলেট, একসময় উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সম্প্রদায়ের, যেমন টোটো, রাজবংশী এবং সাঁওতালদের খাদ্য তালিকায় প্রধান ভূমিকা পালন করত। এই শস্যগুলো শুধুমাত্র পুষ্টিগুণে ভরপুরই নয়, এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মুখেও অত্যন্ত টেকসই। মিলেট চাষে কম জলের প্রয়োজন হয়, এবং এগুলো দুর্বল মাটিতেও ভালোভাবে বেড়ে ওঠে, যা উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি ও বর্ষাভিত্তিক কৃষি অঞ্চলের জন্য আদর্শ। তবে, সবুজ বিপ্লব এবং সরকারি পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের (পিডিএস) মাধ্যমে ধান ও গমের সহজলভ্যতার কারণে এই শস্যগুলো ধীরে ধীরে কৃষকদের ক্ষেত থেকে এবং খাদ্য তালিকা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, উত্তরবঙ্গের আদিবাসী কৃষকরা বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় মিলেট চাষ পুনরুজ্জীবনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, সুইচ অন ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থাগুলো বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার মতো অঞ্চলে মিলেট চাষের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই সংস্থাগুলো কৃষকদের বীজ, প্রশিক্ষণ এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করছে। সুইচ অন ফাউন্ডেশনের প্রধান বিনয় জাজু বলেছেন, “উত্তরবঙ্গের আদিবাসী মহিলা কৃষকরা মিলেট চাষে উৎসাহী শিক্ষার্থী। তারা শুধুমাত্র কৃষিতেই নয়, পুষ্টির বিষয়েও সচেতন।” তিনি আরও জানান, মিলেট রান্নার পদ্ধতি ধান বা গমের থেকে আলাদা, তাই কৃষকদের জন্য রান্নার প্রশিক্ষণ এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, যা তাঁদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করছে।
মিলেটের পুষ্টিগুণ অতুলনীয়। এগুলো প্রোটিন, ফাইবার, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজে সমৃদ্ধ। ধান এবং গমের তুলনায় মিলেটের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, যা ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলেট শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে না, বরং তাঁদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সহায়তা করছে। উদাহরণস্বরূপ, নীলগিরির কুরুম্বা এবং ইরুলা সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলেট পুনরুজ্জীবনের পর তাঁদের রক্তশূন্যতার সমস্যা কমেছে।
উত্তরবঙ্গের টোটো সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলেট চাষের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আলিপুরদুয়ারের টোটোপাড়ায় কৃষকরা কোডো মিলেট চাষ করছেন, যা প্রধানত ‘ইউ’ নামক একটি ঐতিহ্যবাহী পানীয় তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই পানীয়টি তাঁদের সাংস্কৃতিক উৎসব এবং বিবাহের মতো অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেঙ্গট জি কার্লসন, একজন সমাজবিজ্ঞানী, তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেছেন যে টোটো সম্প্রদায়ের কৃষকরা একে অপরের জমিতে পালা করে কাজ করে মিলেট চাষে সহযোগিতা করছেন, যা তাঁদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যকে শক্তিশালী করছে। তবে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কৃষির প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া এবং নগদ ফসল যেমন সুপারি চাষের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে, যা মিলেট চাষের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
মিলেট চাষের পুনরুজ্জীবনের পেছনে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ ঘোষণার পর ভারত সরকার মিলেটকে ‘শ্রী অন্ন’ হিসেবে পুনঃনামকরণ করে এর চাষ এবং ব্যবহারের প্রচারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে, সরকারি স্কিম এবং স্থানীয় এনজিওগুলোর সহযোগিতায় কৃষকদের মধ্যে মিলেটের বীজ বিতরণ, প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। উদাহরণস্বরূপ, সুইচ অন ফাউন্ডেশন বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ায় মিলেট চাষে মহিলা কৃষকদের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এই উদ্যোগগুলো কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
তবে, মিলেট চাষের পুনরুজ্জীবনের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, মিলেট প্রক্রিয়াকরণের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং হাতে প্রক্রিয়াকরণের শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া মহিলা কৃষকদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, বাজারে মিলেটের চাহিদা এখনও ধান ও গমের তুলনায় কম, যদিও শহুরে স্বাস্থ্য সচেতন গ্রাহকদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তৃতীয়ত, ঐতিহ্যবাহী বীজের সংরক্ষণ এবং প্রাপ্যতা একটি বড় সমস্যা। অনেক কৃষক জানিয়েছেন যে তাঁদের পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত মিলেটের বীজ এখন আর পাওয়া যায় না, যা চাষের পুনরুজ্জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো সত্ত্বেও, উত্তরবঙ্গের আদিবাসী কৃষকরা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান এবং সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেট চাষকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁরা শুধুমাত্র নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন না, বরং পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি টেকসই মডেল উপস্থাপন করছেন। মিলেট চাষের এই পুনরুজ্জীবন শুধুমাত্র একটি কৃষি আন্দোলন নয়, বরং আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পুনরুদ্ধারের একটি গল্প। এই উদ্যোগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর, টেকসই এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ পথ তৈরি করছে।