Trailblazers of Rural Bengal: পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে কৃষি খাতে নারীরা এখন নীরব বিপ্লবের পথিকৃৎ হয়ে উঠছেন। কৃষি ও সম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত প্রায় ৮০% গ্রামীণ নারী, তাদের দক্ষতা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে কৃষি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন। পুরুষদের শহরে স্থানান্তরের ফলে কৃষি কাজের দায়িত্ব ক্রমশ নারীদের কাঁধে এসে পড়ছে, এবং তারা এই দায়িত্ব শুধু পালনই করছেন না, বরং নতুন পথ দেখাচ্ছেন। জিআই ট্যাগ পাওয়া গোবিন্দভোগ চালের চাষ থেকে শুরু করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি এবং ফসলের বৈচিত্র্যকরণে, নারীরা তাদের অবদান দিয়ে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছেন। এই নিবন্ধে আমরা পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন অনুপ্রেরণাদায়ী নারী কৃষকের গল্প তুলে ধরব, যারা কৃষি বিপ্লবের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠছেন।
অনামিকা ঘোষ: আলুর চাষে নতুন দিগন্ত
বাঁকুড়া জেলার অনামিকা ঘোষ কখনও কৃষিজমিতে পা রাখেননি। তাঁর পরিবার কৃষিনির্ভর হলেও, তাঁর ভূমিকা ছিল ঘরে আলুর বীজ কাটা ও প্রস্তুত করা। কিন্তু ইউএসএআইডি এবং পেপসিকোর একটি যৌথ উদ্যোগে তিনি কৃষি প্রশিক্ষণ ও ভূমি সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৮০০ নারীর সঙ্গে তিনি টেকসই কৃষি পদ্ধতি এবং আলু চাষের আধুনিক কৌশল শিখেছেন। আজ তিনি একজন সম্প্রদায় কৃষিবিদ হিসেবে কাজ করছেন এবং তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যান্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। অনামিকা বলেন, “আগে আমাকে কেউ কৃষক বলে ডাকত না, কিন্তু এখন আমি গর্বের সঙ্গে বলি আমি একজন কৃষক।” তাঁর নেতৃত্বে আলুর ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাঁর সম্প্রদায়ের নারীরা এখন আর্থিক স্বাধীনতার পথে এগিয়ে চলেছেন।
কাঞ্চন দেবী: বিহারের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে
যদিও কাঞ্চন দেবী বিহারের বাসিন্দা, তাঁর গল্প পশ্চিমবঙ্গের নারী কৃষকদের জন্য অনুপ্রেরণা। মুঙ্গের জেলার লোধিপুর খুর্দ গ্রামে অক্সফাম ইন্ডিয়া এবং সেবা ভারতের উদ্যোগে তিনি সবজি সরবরাহ শৃঙ্খল প্রকল্পে যোগ দেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি কৃষি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং প্রথম নারী-পরিচালিত ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (এফপিও) গঠন করেন। ২০১৮ সালে তাঁকে বিহার সরকার ‘এজেন্ট অফ চেঞ্জ’ পুরস্কারে সম্মানিত করে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার নারী কৃষকরা এখন কাঞ্চনের মডেল অনুসরণ করে এফপিও গঠন করছেন। এই সংগঠনগুলো নারীদের বাজারে প্রবেশ, ঋণ সুবিধা এবং কৃষি সরঞ্জামে অ্যাক্সেস প্রদান করছে। কাঞ্চনের গল্প দেখায় যে নারীদের নেতৃত্ব কীভাবে সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে পারে।
মাধবী মন্ডল: গোবিন্দভোগ চালের পথপ্রদর্শক
নদিয়া জেলার মাধবী মন্ডল গোবিন্দভোগ চাল চাষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৭ সালে গোবিন্দভোগ চাল জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর, মাধবী এবং তাঁর নেতৃত্বে একটি নারী কৃষক গোষ্ঠী এই সুগন্ধি চালের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কাজ শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিপণন বোর্ডের সহায়তায় তাঁরা প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ পেয়েছেন। মাধবী জানান, “জিআই ট্যাগ আমাদের চালের দাম বাড়িয়েছে, এবং এখন আমরা রপ্তানি বাজারেও প্রবেশ করছি।” তাঁদের প্রচেষ্টায় গোবিন্দভোগ চালের রপ্তানি বছরে ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং স্থানীয় কৃষকরা প্রতি হেক্টরে ৫০,০০০-৭০,০০০ টাকা অতিরিক্ত আয় করছেন। মাধবীর নেতৃত্বে নারীরা এখন শুধু চাষই করছেন না, বরং ব্র্যান্ডিং ও বিপণনেও দক্ষতা অর্জন করছেন।

লক্ষ্মী দাস: ভার্মিকম্পোস্টের অগ্রদূত
হুগলি জেলার লক্ষ্মী দাস ভার্মিকম্পোস্টিংয়ের মাধ্যমে জৈব কৃষিতে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জৈব কৃষি মিশনের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি একটি ছোট ভার্মিকম্পোস্ট ইউনিট শুরু করেন। মাত্র ১০,০০০ টাকার বিনিয়োগে তিনি এখন মাসে ১৫,০০০ টাকা আয় করছেন। লক্ষ্মী তাঁর সম্প্রদায়ের ২০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যারা এখন নিজেদের ইউনিট চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমরা বর্জ্য থেকে সার তৈরি করছি এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করছি।” তাঁর প্রচেষ্টায় স্থানীয় কৃষকরা রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৩০% কমিয়েছেন, এবং ফসলের ফলন বেড়েছে।
নারী কৃষকদের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
পশ্চিমবঙ্গে নারী কৃষকরা ভূমির মালিকানা, ঋণ, এবং কৃষি সরঞ্জামে অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হন। মাত্র ১৪% নারীর ভূমির মালিকানা রয়েছে, যা তাদের সরকারি কৃষি সহায়তা থেকে বঞ্চিত করে। তবে, স্বনির্ভর গোষ্ঠী (এসএইচজি) এবং ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (এফপিও) এই বাধা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মহিলা ভূমি সাক্ষরতা প্রোগ্রাম এবং মহিলা কিষান সশক্তিকরণ পরিয়োজনার মতো উদ্যোগ নারীদের ভূমি অধিকার এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এছাড়া, অক্সফাম ইন্ডিয়া এবং ইউএসএআইডির মতো সংস্থাগুলো নারীদের কৃষি প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ এবং আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।,
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গে নারী কৃষকদের নেতৃত্ব কৃষি খাতে টেকসই উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। জিআই ট্যাগযুক্ত পণ্য, ভার্মিকম্পোস্টিং, এবং ফসলের বৈচিত্র্যকরণের মতো উদ্যোগ নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক মর্যাদা বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীদের কৃষি প্রশিক্ষণ এবং ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা হলে, রাজ্যের কৃষি উৎপাদনশীলতা ২০-৩০% বৃদ্ধি পেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার মাধ্যমে এই নারীরা শুধু নিজেদের জীবনই নয়, বরং তাদের সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ গড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ নারীরা কৃষি খাতে তাদের দক্ষতা, নেতৃত্ব এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে একটি নতুন বিপ্লবের সূচনা করছেন। অনামিকা, কাঞ্চন, মাধবী এবং লক্ষ্মীর মতো নারীরা প্রমাণ করছেন যে সঠিক সুযোগ ও সমর্থন পেলে, নারীরা কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারেন। সরকার, এনজিও এবং বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই নারী কৃষকদের আরও ক্ষমতায়ন করা হলে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাত বিশ্বমঞ্চে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠবে।

আমাদের Google News এ ফলো করুন
২৪ ঘণ্টার বাংলা নিউজ, ব্রেকিং আপডেট আর এক্সক্লুসিভ স্টোরি সবার আগে পেতে ফলো করুন।
