পশ্চিমবঙ্গ ভারতের কৃষি (West Bengal agricultural)ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে, ২০২৪ সালে তার কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজ্যের পাঁচটি জেলা—পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, বাঁকুড়া, বীরভূম এবং কোচবিহার—২০২৪ সালে কৃষি উৎপাদন এবং সামগ্রিক কৃষি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। এই জেলাগুলি বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন, পশুপালন, এবং উদ্যানপালনের মাধ্যমে রাজ্যের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এই প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে আমরা এই জেলাগুলির সাফল্যের পেছনের কারণগুলি এবং তাদের অর্জনের বিশদ বিবরণ তুলে ধরব।
পূর্ব বর্ধমান: কৃষি অর্থনীতির পাওয়ারহাউস
পূর্ব বর্ধমান পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এই জেলায় প্রায় ৫৮% জনসংখ্যা কৃষি এবং সম্পর্কিত কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। ধান, আলু, তেলবীজ, এবং শাকসবজির মতো ফসল এখানে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয়। ২০২৪ সালে, পূর্ব বর্ধমান ধান উৎপাদনে রাজ্যের মধ্যে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে, যা ভারতের মোট ধান উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এছাড়াও, জেলাটি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার এবং প্যাডি ট্রান্সপ্লান্টারের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে, যা উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। জৈব কৃষি এবং মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা মাটির উর্বরতা ধরে রাখতে সহায়তা করেছে।
Also Read | মেঘদূত-মৌসম অ্যাপে কৃষকের অগ্রগতির দিশা দেখাচ্ছে ভারত
হুগলি: কৃষি শিল্পের কেন্দ্র
হুগলি জেলা কৃষি-ভিত্তিক শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে প্রায় ৭০% জনসংখ্যা কৃষির উপর নির্ভরশীল। ধান, আলু, তেলবীজ, গম, এবং ডাল জাতীয় ফসল এখানে প্রধানত উৎপাদিত হয়। ২০২৪ সালে, হুগলি জেলা জৈব কৃষি এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, যেমন মাটির স্বাস্থ্য কার্ড প্রকল্প এবং জৈব সার ব্যবহারের প্রচার, এই জেলায় কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়াও, হুগলি জেলায় কৃষি বিপণন কাঠামো উন্নত করা হয়েছে, যা কৃষকদের তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছে।
বাঁকুড়া: খরা-প্রবণ জেলায় কৃষি সাফল্য
বাঁকুড়া জেলা, যা প্রায়শই খরার সমস্যায় ভোগে, ২০২৪ সালে কৃষি উৎপাদনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। ধান, আলু, সরিষা, এবং শাকসবজির মতো ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলাটি তেলবীজ এবং ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন জাতের বীজ প্রবর্তন করেছে, যেমন আরহার, মসুর, এবং ছোলা। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার, যেমন প্যাডি রিপার এবং ড্রাম সিডার, কৃষকদের দক্ষতা বাড়িয়েছে। বাঁকুড়ায় বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা খরা-প্রবণ এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

Mixed Farming, Bengal Agriculture, Agricultural Universities, Sustainable Farming
বীরভূম: ধান উৎপাদনের কেন্দ্র
বীরভূম জেলা তার ধান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত, যা জেলার মোট চাষযোগ্য জমির ৯৪% জুড়ে রয়েছে। ২০২৪ সালে, এই জেলা ধান, তেলবীজ, গম, এবং শাকসবজির উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। জেলার কৃষি-জলবায়ু পরিস্থিতি, ময়ূরাক্ষী খাল প্রকল্প, এবং ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। তবে, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এখানে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। রাজ্য সরকার জৈব কৃষি এবং মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছে, যা কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়েছে।
Also Read | আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে কৃষি খাতে সাফল্যের নজির গড়ল ভারত
কোচবিহার: উত্তরের কৃষি রত্ন
কোচবিহার জেলা, যা পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত, ২০২৪ সালে কৃষি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। এই জেলায় ধান, ভুট্টা, আলু, সরিষা, এবং বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদিত হয়। কোচবিহারের কৃষকরা আধুনিক কৃষি পদ্ধতি এবং উন্নত বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়েছে। এছাড়াও, জেলাটি পশুপালন এবং মৎস্য চাষে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। ২০২৪ সালে, কোচবিহার মাংস উৎপাদনে রাজ্যের মধ্যে শীর্ষে ছিল, যা জাতীয় পর্যায়ে ১২.৬% অবদান রেখেছে।
কৃষি প্রবৃদ্ধির পেছনের কারণ
এই পাঁচটি জেলার কৃষি প্রবৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কৃষি প্রকল্প, যেমন প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি, মাটির স্বাস্থ্য কার্ড প্রকল্প, এবং জাতীয় কৃষি উন্নয়ন যোজনা, কৃষকদের আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করেছে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং উন্নত বীজের প্রবর্তন উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। তৃতীয়ত, সেচ ব্যবস্থার উন্নতি এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উদ্যোগ খরা-প্রবণ এলাকায় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও এই জেলাগুলি কৃষি প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। মাটির উর্বরতা হ্রাস, রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা এবং খরা কৃষি উৎপাদনের জন্য হুমকি হিসেবে রয়েছে। এছাড়াও, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং বিপণন ব্যবস্থার অভাব একটি বড় সমস্যা। তবে, রাজ্য সরকারের টেকসই কৃষি নীতি এবং জৈব কৃষির প্রচার এই সমস্যাগুলি মোকাবেলায় সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের এই পাঁচটি জেলা—পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, বাঁকুড়া, বীরভূম, এবং কোচবিহার—২০২৪ সালে কৃষি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের সাফল্য রাজ্যের কৃষি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং ভারতের সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আধুনিক প্রযুক্তি, সরকারি সহায়তা, এবং কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এই জেলাগুলি কৃষি ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। ভবিষ্যতে, টেকসই কৃষি পদ্ধতি এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।