বাংলার খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য শীর্ষ ৫টি কম জলের সবজি চাষ

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে জলসংকট একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘ খরা এবং ভূগর্ভস্থ জলের স্তর হ্রাসের কারণে কৃষকদের জন্য ফসল উৎপাদন (Low-Water Vegetables)…

Top 5 Low-Water Vegetables for Drought-Prone West Bengal

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে জলসংকট একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘ খরা এবং ভূগর্ভস্থ জলের স্তর হ্রাসের কারণে কৃষকদের জন্য ফসল উৎপাদন (Low-Water Vegetables) একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো খরাপ্রবণ অঞ্চলগুলিতে জলের অভাব কৃষি উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে, কম জলের প্রয়োজন এমন সবজি চাষের মাধ্যমে এই অঞ্চলের কৃষকরা তাদের ফলন বজায় রাখতে পারেন এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত শীর্ষ ৫টি কম জলর সবজির কথা আলোচনা করব, যা কৃষকদের জন্য খরচ কমানোর পাশাপাশি ফলন বাড়াতে সাহায্য করবে।

১. ঢেঁড়স (Okra)
ঢেঁড়স (Abelmoschus esculentus) খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য একটি আদর্শ সবজি। এই ফসল উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালোভাবে বেড়ে ওঠে এবং এর গভীর শিকড় ব্যবস্থা মাটির গভীর থেকে জল সংগ্রহ করতে সক্ষম। ঢেঁড়সের চাষে সপ্তাহে একবার প্রায় ১ ইঞ্চি জল সরবরাহ করলেই যথেষ্ট, বিশেষ করে গাছ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। পশ্চিমবঙ্গের শুষ্ক অঞ্চলে এই ফসল জনপ্রিয় কারণ এটি উচ্চ তাপমাত্রা এবং কম জলর পরিস্থিতিতে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। উপযুক্ত জাতের মধ্যে রয়েছে ‘Arka Anamika’ এবং ‘Pusa Sawani’, যা খরা সহনশীল এবং উচ্চ ফলন দেয়। ঢেঁড়সের চাষে মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করলে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।

   

২. পালং শাক (Amaranth/Warrigal Greens)
পালং শাক বা আমরান্থ (Amaranthus spp.) পশ্চিমবঙ্গের খরাপ্রবণ অঞ্চলে চাষের জন্য একটি পুষ্টিকর এবং কম জলর ফসল। এই শাকসবজি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং খরা সহনশীলতার জন্য পরিচিত। এর পাতা ও বীজ উভয়ই ভোজ্য এবং এটি ন্যূনতম জলর মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে ‘লাল শাক’ বা ‘নোটে শাক’ হিসেবে পরিচিত এই ফসলের জাতগুলি, যেমন ‘Pusa Kiran’, খুব কম জলর প্রয়োজন হয়। গাছ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এটি মাটির অবশিষ্ট আর্দ্রতার উপর নির্ভর করতে পারে। মালচিং এবং ড্রিপ ইরিগেশনের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করলে এই ফসলের ফলন আরও বাড়ানো যায়।

৩. টমেটো (Tomato – Roma/Cherry Varieties)
টমেটো (Solanum lycopersicum) সাধারণত জলর প্রয়োজন হলেও, কিছু নির্দিষ্ট জাত, যেমন ‘Roma’ এবং ‘Sun Gold’, খরা সহনশীল। এই জাতগুলি কম জলতে বেড়ে উঠতে পারে এবং পশ্চিমবঙ্গের শুষ্ক অঞ্চলে চাষের জন্য উপযুক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে টমেটো গাছকে নিয়মিত জল সরবরাহ করতে হয়, তবে শিকড় স্থাপিত হওয়ার পর এটি কম জলতে ফলন দিতে পারে। বিশেষ করে ‘Dry Farming’ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করলে ফলের স্বাদ আরও সমৃদ্ধ হয়। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা মালচিং এবং জৈব সার ব্যবহার করে এই ফসলের ফলন বাড়াতে পারেন। টমেটোর গভীর শিকড় ব্যবস্থা মাটির গভীর থেকে জল সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।

Top 5 Low-Water Vegetables for Drought-Prone West Bengal
Top 5 Low-Water Vegetables for Drought-Prone West Bengal

৪. মরিচ (Peppers – Hot/Chilli Varieties)
মরিচ, বিশেষ করে গরম মরিচ বা চিলি পেপার (Capsicum spp.), খরা সহনশীল এবং পশ্চিমবঙ্গের উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে চাষের জন্য আদর্শ। এই গাছগুলির পুরু পাতা জলর ক্ষয় কমায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে শুষ্ক পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে। ‘Pusa Jwala’ এবং ‘Bird’s Eye Chili’ জাতগুলি পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় এবং কম জলর প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সপ্তাহে ১ ইঞ্চি জল সরবরাহ করলে গাছ প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং পরে এটি ন্যূনতম জলতে ফলন দিতে পারে। মরিচের চাষে ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবহার করলে জলর অপচয় কম হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়।

৫. বেগুন (Eggplant)
বেগুন (Solanum melongena) আরেকটি কম জলর সবজি, যা পশ্চিমবঙ্গের খরাপ্রবণ অঞ্চলে চাষের জন্য উপযুক্ত। এর পুরু পাতা এবং গভীর শিকড় ব্যবস্থা জলর ক্ষয় কমায় এবং শুষ্ক পরিস্থিতিতে ফলন বজায় রাখে। ‘Pusa Purple Long’ এবং ‘Ping Tung’ জাতগুলি খরা সহনশীল এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়। বেগুনের চাষে জৈব মালচ, যেমন খড় বা শুকনো পাতা, ব্যবহার করলে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই ফসল সাধারণত ৬০-৭০ দিনের মধ্যে ফলন দেয় এবং ন্যূনতম জলর প্রয়োজন হয়।

Advertisements

কেন কম জলর ফসল গুরুত্বপূর্ণ?
পশ্চিমবঙ্গের খরাপ্রবণ অঞ্চলগুলিতে জলের অভাব কৃষকদের জন্য একটি বড় সমস্যা। ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের প্রায় ২০% কৃষিজমি খরাপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। এই অঞ্চলগুলিতে বৃষ্টির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে কম জলর ফসল চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ফসলগুলি শুধু জলর ব্যবহার কমায় না, বরং কৃষকদের খরচ কমাতে এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

চাষের কৌশল ও সুপারিশ
১. মালচিং: জৈব মালচ, যেমন খড়, শুকনো পাতা বা ঘাস, মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং জলর বাষ্পীভবন কমায়।
২. ড্রিপ ইরিগেশন: এই পদ্ধতি জলর অপচয় কমায় এবং গাছের শিকড়ে সরাসরি জল সরবরাহ করে।
৩. সঠিক সময়ে চাষ: বসন্ত বা শরৎকালে বীজ বপন করলে বৃষ্টির জল ব্যবহার করা যায় এবং সেচের প্রয়োজন কমে।
৪. মাটির উন্নতি: জৈব সার এবং কম্পোস্ট ব্যবহার করে মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ানো যায়।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের জন্য সুযোগ
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিভাগ খরাপ্রবণ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে, যেমন ‘জলধরো জলভরো’ এবং ড্রিপ ইরিগেশন স্কিম। এই প্রকল্পগুলি কৃষকদের কম জলর ফসল চাষে উৎসাহিত করে এবং আধুনিক সেচ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এছাড়া, খরা সহনশীল বীজ সরবরাহ এবং ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা করা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের খরাপ্রবণ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য কম জলর সবজি চাষ একটি টেকসই সমাধান। ঢেঁড়স, পালং শাক, টমেটো, মরিচ এবং বেগুনের মতো ফসলগুলি ন্যূনতম জলর প্রয়োজন হয় এবং উচ্চ ফলন দেয়। সঠিক চাষ পদ্ধতি এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে কৃষকরা এই ফসলগুলির মাধ্যমে তাদের জীবিকা উন্নত করতে পারেন। জলসংকটের এই সময়ে, কম জলর ফসল চাষ শুধু কৃষি উৎপাদনই বাড়াবে না, বরং পরিবেশ সংরক্ষণেও অবদান রাখবে।