খরিফ ফসল আক্রমণকারী শীর্ষ ৩টি রোগ থেকে ফলন রক্ষার উপায়

খরিফ মরসুম, যা জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিস্তৃত, ভারতের কৃষি ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে ধান, ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, ডাল এবং চিনাবাদামের মতো ফসল…

PMFBY Crop Insurance 2025

খরিফ মরসুম, যা জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিস্তৃত, ভারতের কৃষি ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে ধান, ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, ডাল এবং চিনাবাদামের মতো ফসল চাষ করা হয়। তবে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বৃষ্টির সঙ্গে আর্দ্রতা এবং উষ্ণ আবহাওয়া ফসলের রোগ এবং কীটপতঙ্গের (Kharif Crop Diseases) প্রকোপ বাড়ায়। ২০২৫ সালের খরিফ মরসুমে তিনটি প্রধান রোগ ফসলের ফলনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে: ধানের ব্লাস্ট রোগ, ভুট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম এবং তুলার পিঙ্ক বোলওয়ার্ম। এই প্রতিবেদনে আমরা এই রোগগুলির বিবরণ, তাদের প্রভাব এবং ফলন রক্ষার জন্য কৃষকদের জন্য কার্যকর সুরক্ষা কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।

১. ধানের ব্লাস্ট রোগ (Rice Blast Disease)
ধানের ব্লাস্ট রোগ, যা ম্যাগনাপোর্থে ওরিজি নামক ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট, খরিফ মরসুমে ধানের ফসলের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি। এই রোগ ধানের পাতা, কান্ড, এবং শীষে আক্রমণ করে, যার ফলে ফলন ৩০% থেকে ৬০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ২০২৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো ধান উৎপাদনকারী রাজ্যগুলিতে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা গেছে। উচ্চ আর্দ্রতা এবং ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে।
লক্ষণ:
পাতায় ধূসর-সাদা বা বাদামী দাগ।
শীষে কালো দাগ এবং শস্যের অকাল পাকা।
কান্ডে ধূসর-সবুজ দাগ এবং ফসলের মৃত্যু।

   

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ:

  • প্রতিরোধী জাত: ব্লাস্ট-প্রতিরোধী ধানের জাত যেমন IR64 বা Swarna-Sub1 ব্যবহার করুন।
  • বীজ শোধন: বীজ বপনের আগে কার্বেন্ডাজিম বা ট্রাইসাইক্লাজল দিয়ে বীজ শোধন করুন।
  • সাংস্কৃতিক পদ্ধতি: ফসলের ঘনত্ব কমানো, জমিতে জলাবদ্ধতা প্রতিরোধ এবং নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এড়ানো।
  • রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: ট্রাইসাইক্লাজল বা প্রোপিকোনাজলের মতো ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন, তবে সঠিক মাত্রায় এবং সময়ে।
  • নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: ফসলের প্রাথমিক পর্যায়ে সাপ্তাহিক স্কাউটিং করে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করুন।

২. ভুট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম (Fall Armyworm)
ফল আর্মিওয়ার্ম (Spodoptera frugiperda) ভুট্টার ফসলের জন্য একটি মারাত্মক কীটপতঙ্গ, যা ২০২৫ সালের খরিফ মরসুমে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং তেলেঙ্গানার মতো রাজ্যগুলিতে ব্যাপক ক্ষতি করছে। এই কীটপতঙ্গ ফসলের পাতা, কান্ড এবং শীষ খেয়ে ফেলে, যার ফলে ফলন ২৫-৫০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া এই কীটের প্রজনন এবং বিস্তারকে উৎসাহিত করে।
লক্ষণ:
পাতায় ছোট ছোট ছিদ্র এবং অনিয়মিত কাটা দাগ।
ভুট্টার শীষে কীটের মল এবং ক্ষত।
গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত এবং শীষের ক্ষতি।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ:

Advertisements
  • ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (IPM): জৈব এবং রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের সমন্বয় ব্যবহার করুন। ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করে কীটের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন।
  • জৈব নিয়ন্ত্রণ: Trichogramma পরজীবী পোকা বা Bacillus thuringiensis (Bt) ভিত্তিক জৈব কীটনাশক ব্যবহার করুন।
  • রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: স্পিনোস্যাড বা ইমামেকটিন বেনজোয়েটের মতো কীটনাশক স্প্রে করুন, তবে সঠিক সময়ে এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শে।
  • ফসল ঘূর্ণন: ভুট্টার সঙ্গে ডাল জাতীয় ফসল ঘূর্ণন করুন যাতে কীটের জীবনচক্র ভাঙা যায়।
  • আগাম সতর্কতা: ভারতের কৃষি গবেষণা পরিষদ (ICAR) এবং স্থানীয় কৃষি বিভাগের সতর্কতা অনুসরণ করুন।

৩. তুলার পিঙ্ক বোলওয়ার্ম (Pink Bollworm)
পিঙ্ক বোলওয়ার্ম (Pectinophora gossypiella) তুলা ফসলের জন্য একটি গুরুতর হুমকি, বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং গুজরাটে। ২০২৫ সালে, এই কীটপতঙ্গ তুলার ফলন ২০-৪০% কমিয়েছে। এটি তুলার বোলের ভিতরে প্রবেশ করে এবং ফাইবারের গুণমান নষ্ট করে।
লক্ষণ:
তুলার বোলে ছোট ছিদ্র এবং লার্ভার উপস্থিতি।
বোলের অভ্যন্তরে ক্ষত এবং ফাইবারের ক্ষতি।
ফসলের অকাল পতন এবং ফলন হ্রাস।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ:

  • Bt তুলা: Bt তুলার জাত ব্যবহার করুন, যা পিঙ্ক বোলওয়ার্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী।
  • ফেরোমোন ফাঁদ: পিঙ্ক বোলওয়ার্মের জনসংখ্যা পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করুন।
  • রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল বা ফ্লুবেনডিয়ামাইডের মতো কীটনাশক ব্যবহার করুন।
  • সাংস্কৃতিক পদ্ধতি: ফসলের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করুন এবং ফসল ঘূর্ণন ব্যবহার করুন।
  • সময়মতো বপন: মৌসুমের শুরুতে বপন করুন যাতে ফসলের প্রাথমিক পর্যায়ে কীটের আক্রমণ কম হয়।

সাধারণ সুরক্ষা কৌশল
২০২৫ সালের খরিফ মরসুমে ফসলের ফলন রক্ষার জন্য কৃষকদের কিছু সাধারণ কৌশল অবলম্বন করা উচিত:

  • ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (IPM): জৈব, রাসায়নিক এবং সাংস্কৃতিক পদ্ধতির সমন্বয় ব্যবহার করুন।
  • মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা: মাটির পুষ্টি এবং pH পরীক্ষা করে সঠিক সার প্রয়োগ করুন।
  • ফসল ঘূর্ণন: ফসল ঘূর্ণনের মাধ্যমে রোগ এবং কীটপতঙ্গের জীবনচক্র ভাঙুন।
  • আবহাওয়ার পূর্বাভাস: ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের (IMD) পূর্বাভাস অনুসরণ করে বপনের সময় নির্ধারণ করুন।
  • কৃষি বীমা: ক্ষেমা জেনারেল ইনস্যুরেন্সের মতো কৃষি বীমা নিন যাতে বন্যা বা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমানো যায়।

২০২৫ সালের খরিফ মরসুমে ধানের ব্লাস্ট রোগ, ভুট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম এবং তুলার পিঙ্ক বোলওয়ার্ম ফসলের জন্য প্রধান হুমকি। তবে, সঠিক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফলন রক্ষা করতে পারেন। প্রতিরোধী ফসলের জাত, সময়মতো স্কাউটিং, জৈব এবং রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের সমন্বয় এবং কৃষি বীমার মতো উদ্যোগ কৃষকদের সুরক্ষা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। স্থানীয় কৃষি বিভাগ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ।