ভারতের কৃষি খাত, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং প্রায় ৭০% গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস, বর্তমানে একটি অভূতপূর্ব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলো (Indian Agritech Startups), যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), ড্রোন প্রযুক্তি এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের সমস্যা সমাধানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এই স্টার্টআপগুলো কেবল ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে না, বরং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি, সম্পদের অপচয় কমানো এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচলন করছে। স্টার্টআপ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বর্তমানে প্রায় ২৮০০ অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপ রয়েছে, যারা ২০২২ সালে ২.৪ বিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে। এই নিবন্ধে আমরা ভারতের শীর্ষ ১০ অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপের কথা তুলে ধরছি, যারা কৃষকদের জন্য বাস্তব সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে এবং ভারতীয় কৃষি জগতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে।
১. নিনজাকার্ট (Ninjacart)
নিনজাকার্ট ভারতের শীর্ষস্থানীয় অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলোর মধ্যে একটি, যারা কৃষি সাপ্লাই চেইনের অদক্ষতা দূর করতে কাজ করছে। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক স্টার্টআপ কৃষকদের সরাসরি খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে, মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা হ্রাস করে। এই প্ল্যাটফর্ম ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং লজিস্টিক অপটিমাইজেশন ব্যবহার করে ফসল কাটার ১২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়। নিনজাকার্ট টাইগার গ্লোবাল, অ্যাক্সেল এবং স্টিডভিউ ক্যাপিটালের মতো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য তহবিল সংগ্রহ করেছে। তাদের লক্ষ্য কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা এবং খাদ্যের অপচয় কমানো।
২. ডিহাট (DeHaat)
২০১২ সালে শশাঙ্ক কুমার এবং মনীশ কুমার প্রতিষ্ঠিত ডিহাট একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যা কৃষকদের জন্য বীজ, সার, কীটনাশকের মতো কৃষি উপকরণ, পরামর্শ পরিষেবা এবং বাজার সংযোগ প্রদান করে। এই স্টার্টআপ ২.৭ মিলিয়নের বেশি কৃষকদের সেবা দিচ্ছে এবং ১০টি আঞ্চলিক ভাষায় সহায়তা প্রদান করে। ডিহাটের AI-ভিত্তিক পরামর্শ পরিষেবা কৃষকদের কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মাধ্যমে ফসলের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে। স্টার্টআপটি ১৯.৩ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে এবং এর লক্ষ্য ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ মিলিয়ন কৃষকের কাছে পৌঁছানো।
৩. ক্রপইন (CropIn)
বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক ক্রপইন ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপ, যা AI এবং বিগ ডেটা ব্যবহার করে কৃষকদের রিয়েল-টাইম ফসল পর্যবেক্ষণ এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। এই প্ল্যাটফর্ম ১৩০টিরও বেশি দেশে ৭ মিলিয়ন কৃষকের সঙ্গে কাজ করে এবং ৬৮.৯ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। ক্রপইনের স্মার্টফার্ম প্লাস সমাধান স্যাটেলাইট ডেটা, ড্রোন এবং IoT ডিভাইসের মাধ্যমে কৃষকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে, যা ফসলের উৎপাদনশীলতা ৩০% পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
৪. ওয়েকুল (WayCool)
চেন্নাই-ভিত্তিক ওয়েকুল ভারতের বৃহত্তম কৃষি ও খাদ্য সাপ্লাই চেইন স্টার্টআপগুলোর মধ্যে একটি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপ ৩৫,০০০ কৃষকের সঙ্গে কাজ করে এবং ৩৪২ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। ওয়েকুল মাটি থেকে বিক্রয় পর্যন্ত একটি জটিল সাপ্লাই চেইন পরিচালনা করে, যা কৃষকদের জন্য লাভজনকতা বাড়ায় এবং খাদ্যের অপচয় কমায়। এটি ফল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত পণ্য এবং অন্যান্য মুদি সামগ্রী সরবরাহ করে।
৫. অ্যাগ্রোস্টার (AgroStar)
২০১৩ সালে শার্দুল শেঠ এবং সিতাংশু শেঠ প্রতিষ্ঠিত অ্যাগ্রোস্টার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যা কৃষকদের কৃষি উপকরণ এবং বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করে। এই স্টার্টআপ ৪ লক্ষের বেশি কৃষকের সঙ্গে কাজ করে এবং ১৮টি রাজ্যে ১৩০০টির বেশি গুদাম পরিচালনা করে। অ্যাগ্রোস্টার ৫০০ মিলিয়ন টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছে এবং সম্প্রতি ভারতীয় শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেছে।
৬. ফাসাল (Fasal)
ফাসাল একটি AI-চালিত প্ল্যাটফর্ম, যা কৃষকদের মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ার তথ্য সরবরাহ করে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপ স্থানীয় ভাষায় কৃষকদের সতর্কতা প্রদান করে, যা সেচ এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ফাসালের প্রযুক্তি কৃষি দক্ষতা এবং টেকসইতা বাড়িয়েছে।
৭. ইনটেলো ল্যাবস (Intello Labs)
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইনটেলো ল্যাবস AI এবং ইমেজ রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি পণ্যের গুণমান মূল্যায়ন করে। এটি ফসলের ক্ষতি কমায় এবং বাজার মূল্য বাড়ায়। স্টার্টআপটি ২.৮২ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে।
৮. কিসানকনেক্ট (KisanKonnect)
২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত কিসানকনেক্ট ৫০০০ কৃষকের সঙ্গে কাজ করে, সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পণ্য সরবরাহ করে। এটি মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কমিয়ে কৃষকদের আয় বাড়ায়।
৯. ফ্রেশোকার্টজ (FreshoKartz)
ফ্রেশোকার্টজ কৃষকদের জন্য একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস, যেখানে তারা কীটনাশক, বীজ এবং সার কিনতে পারে। এটি তাৎক্ষণিক পেমেন্ট এবং স্বচ্ছতার জন্য পরিচিত।
১০. ভেগ্রো (Vegrow)
২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত ভেগ্রো একটি B2B ফলের মার্কেটপ্লেস, যা কৃষকদের ফসলের গ্রেডিং, প্যাকেজিং এবং লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করে। এটি ৮৬.৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ভারতের অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলো গ্রামীণ এলাকায় সীমিত ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, কৃষকদের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এবং খণ্ডিত কৃষি বাজারের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। তবে, এই স্টার্টআপগুলো ব্যবহারকারী-বান্ধব প্ল্যাটফর্ম এবং শক্তিশালী সহায়তা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করছে। ভারত সরকারের স্টার্টআপ ইন্ডিয়া, প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চন যোজনা এবং ই-ন্যামের মতো উদ্যোগ এই খাতকে সমর্থন করছে। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, অ্যাগ্রিটেক শিল্প ২০২৭ সালের মধ্যে ১২.১% বার্ষিক বৃদ্ধির হারে বাড়বে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপিতে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের অবদান রাখবে।
এই স্টার্টআপগুলো কৃষকদের আয় ৩৫% বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই কৃষি নিশ্চিত করছে। ভবিষ্যতে, AI, রিমোট সেন্সিং এবং বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলো ভারতীয় কৃষিকে আরও পরিবেশবান্ধব এবং জলবায়ু-সহনশীল করে তুলবে। এই উদ্ভাবনী স্টার্টআপগুলো ভারতীয় কৃষিকে বিশ্বমঞ্চে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতি এবং কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।