ভারতের গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মানুষের জন্য অতিরিক্ত আয়ের একটি সম্ভাবনাময় উৎস হয়ে উঠেছে মাশরুম চাষ (Mushroom Farming)। কম বিনিয়োগ, স্বল্প জায়গা এবং দ্রুত লাভের কারণে মাশরুম চাষ এখন কৃষক, গৃহিণী এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাশরুম উৎপাদন গত দশকে ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এটি বছরে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার বাজার গড়ে তুলেছে। একটি ছোট ঘরে মাশরুম চাষ শুরু করে কৃষক বা উদ্যোক্তারা মাসে ২০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা আয় করতে পারেন। এই নিবন্ধে আমরা মাশরুম চাষের প্রাথমিক পদক্ষেপ, সুবিধা এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
মাশরুম চাষের সুবিধা
মাশরুম চাষ একটি কম খরচের ব্যবসা, যা ছোট জায়গায় শুরু করা যায়। এটির জন্য বড় কৃষিজমি বা জটিল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন নেই। মাত্র ১০০-২০০ বর্গফুট জায়গায় ৫০০-১০০০ কেজি মাশরুম উৎপাদন সম্ভব। ভারতে সাধারণত তিন ধরনের মাশরুম চাষ করা হয়—বাটন (Agaricus bisporus), ঝিনুক (Oyster), এবং শিতাকে (Shiitake)। এর মধ্যে ঝিনুক মাশরুম চাষ সবচেয়ে সহজ এবং কম খরচে শুরু করা যায়। প্রতি কেজি মাশরুমের বাজার মূল্য ১৫০-৩০০ টাকা, এবং একটি ফসল চক্রে (৪৫-৬০ দিন) ৫০-৭০% লাভ সম্ভব।
মাশরুম চাষ শুধু আয়ের উৎসই নয়, এটি পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ। মাশরুমে প্রোটিন, ভিটামিন (বি এবং ডি), এবং খনিজ পদার্থ থাকে, যা স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এছাড়া, মাশরুম চাষ পরিবেশবান্ধব, কারণ এটি কৃষি বর্জ্য যেমন খড়, ধানের তুষ, বা গোবর ব্যবহার করে।
মাশরুম চাষ শুরু করার পদক্ষেপ
১. প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান অর্জন: মাশরুম চাষ শুরু করার আগে প্রশিক্ষণ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ভারতের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, এবং জাতীয় মাশরুম গবেষণা কেন্দ্র (DMR, সোলান) প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এই প্রশিক্ষণে মাশরুম স্পন (বীজ), কম্পোস্ট তৈরি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে শেখানো হয়।
২. উপযুক্ত স্থান নির্বাচন: মাশরুম চাষের জন্য ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৮০-৯০% আর্দ্রতা প্রয়োজন। একটি ছোট ঘর, শেড, বা পলিহাউস এই কাজে ব্যবহার করা যায়। জায়গাটি পরিষ্কার, অন্ধকার এবং ভালো বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকা চাই।
৩. উপকরণ সংগ্রহ: মাশরুম চাষের জন্য স্পন, কম্পোস্ট (খড়, গোবর, বা অন্যান্য জৈব পদার্থ), পলিব্যাগ, এবং স্প্রে যন্ত্র প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে ১০০০ কেজি কম্পোস্টের জন্য প্রায় ২০,০০০-৩০,০০০ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন। সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে এই খরচ ৫০% পর্যন্ত কমানো যায়।
৪. চাষ প্রক্রিয়া: প্রথমে কম্পোস্ট তৈরি করে তাতে স্পন মেশানো হয়। এরপর পলিব্যাগে ভরে আর্দ্র পরিবেশে রাখা হয়। ১৫-২০ দিনের মধ্যে মাশরুম বাড়তে শুরু করে, এবং ৪৫-৬০ দিনে ফসল কাটা যায়। প্রতি ব্যাগ থেকে ১-২ কেজি মাশরুম পাওয়া যায়।
৫. বাজারজাতকরণ: মাশরুমের চাহিদা স্থানীয় বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, এবং সুপারমার্কেটে বাড়ছে। এছাড়া, শুকনো মাশরুম রপ্তানি করে অতিরিক্ত আয় করা যায়। অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপ যেমন নিনজাকার্ট বা ফ্রেশোকার্টজ মাশরুম উৎপাদকদের জন্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস সরবরাহ করছে।
সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ
ভারত সরকারের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ এবং ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষি সমৃদ্ধি যোজনা’র অধীনে মাশরুম চাষের জন্য ভর্তুকি এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। জাতীয় উদ্যানপালন মিশন (NHM) এবং রাজ্য সরকারগুলো ৫০-৮০% ভর্তুকি দিয়ে মাশরুম চাষে উৎসাহিত করছে। পশ্চিমবঙ্গে, কৃষি বিভাগ এবং কৃষি বিপণন বোর্ড মাশরুম চাষের জন্য প্রশিক্ষণ এবং স্পন সরবরাহ করছে। উদাহরণস্বরূপ, মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়া জেলায় কৃষকরা মাশরুম চাষের মাধ্যমে বছরে ১-২ লক্ষ টাকা আয় করছেন।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
মাশরুম চাষে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা, রোগ প্রতিরোধ, এবং বাজার অ্যাক্সেস। অনেক কৃষক সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে ব্যর্থ হন। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ পরিষেবা দিচ্ছে। এছাড়া, স্থানীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলো কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করছে। বাজারজাতকরণের জন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় সমবায় সমিতিগুলো মাশরুম উৎপাদকদের সহায়তা করছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ভারতে মাশরুমের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, যেখানে স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তারা মাশরুমকে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে, শুকনো এবং জৈব মাশরুমের চাহিদা বাড়ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে মাশরুম উৎপাদন দ্বিগুণ করা। পশ্চিমবঙ্গে, দার্জিলিং, কোচবিহার, এবং হাওড়া জেলায় মাশরুম চাষের সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে স্থানীয় কৃষকরা ইতিমধ্যে এই ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করছেন।
মাশরুম চাষ একটি কম খরচের, উচ্চ লাভজনক ব্যবসা, যা ছোট ঘরে শুরু করে কৃষক, গৃহিণী এবং তরুণ উদ্যোক্তারা অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ পেতে পারেন। সরকারি ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ, এবং অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলোর সহায়তায় এই শিল্প আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। মাশরুম চাষ শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, এটি কৃষি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং পরিবেশ রক্ষায়ও অবদান রাখে। যারা নতুন ব্যবসার পথ খুঁজছেন, তাদের জন্য মাশরুম চাষ একটি সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে।