পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য সেচ ব্যয় সবসময়ই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত পাম্পের উপর নির্ভরশীলতা এবং অস্থির বিদ্যুৎ সরবরাহ কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তুলেছে। তবে, সৌরশক্তিচালিত পাম্পের (Solar pumps) আগমন এই চিত্র বদলে দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা এখন সৌর পাম্প ব্যবহার করে সেচের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে তাদের লাভের পরিমাণ বাড়াচ্ছেন। এই প্রযুক্তি শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকই নয়, পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই কৃষির দিকে একটি বড় পদক্ষেপ।
নদীয়া জেলার হাঁসখালি ব্লকের হাজারিনগর গ্রামের কৃষক সঞ্জিত বিশ্বাস একজন উদাহরণ। তিনি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার এক একর জমিতে সৌরশক্তিচালিত পাম্প স্থাপন করেন। এর ফলে গত বোরো মৌসুমে তিনি প্রায় ১৫,০০০ টাকার জ্বালানি খরচ বাঁচিয়েছেন। মোট ২.৩৭ লক্ষ টাকার পাম্প স্থাপনের জন্য রাজ্য সরকার ১.৪২ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে এবং বাকি ৯৫,০৪০ টাকার জন্য ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট (NABARD) থেকে ৫ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সঞ্জিত বলেন, “আগে ডিজেল পাম্পের জন্য অনেক খরচ হতো। এখন সৌর পাম্পের কারণে আমার লাভ অনেক বেড়েছে।”
সৌর পাম্পের প্রধান সুবিধা হলো এটি বিনামূল্যে সূর্যের আলো ব্যবহার করে। ডিজেল পাম্পের তুলনায় এটি ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত সেচ খরচ কমায়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সৌর পাম্প ব্যবহারকারী কৃষকরা ডিজেল পাম্প ব্যবহারকারীদের তুলনায় ৭-৮ শতাংশ বেশি ফলন পাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গেও এই প্রযুক্তি কৃষকদের ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করছে। এছাড়া, সৌর পাম্প পরিবেশবান্ধব। এটি কার্বন নির্গমন কমায় এবং ডিজেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিষান উর্জা সুরক্ষা এবং উত্থান মহাভিয়ান (PM-KUSUM) প্রকল্প এই পরিবর্তনের পিছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। এই প্রকল্পের আওতায় কৃষকরা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি পাচ্ছেন (৩০ শতাংশ কেন্দ্রীয় সরকার এবং ৩০ শতাংশ রাজ্য সরকার থেকে)। তফশিলি জাতি ও উপজাতি কৃষকদের জন্য ভর্তুকি আরও বেশি, ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। এই প্রকল্পের তিনটি উপাদান—গ্রিড-সংযুক্ত সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, অফ-গ্রিড সৌর পাম্প স্থাপন এবং গ্রিড-সংযুক্ত কৃষি পাম্পের সৌরায়ন—কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সেচ ব্যয় কমাতে সহায়ক।
তবে, পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন তুলনামূলকভাবে ধীর। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট ৩,০০,০০০ সৌর পাম্পের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১,০০০-এরও কম স্থাপিত হয়েছে। ২৩,৭০০ পাম্পের জন্য অনুমোদন দেওয়া হলেও এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত মাত্র ২০টি পাম্প স্থাপিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজ্য সরকারের নীতিগত সংরক্ষণ এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগের অভাব এর জন্য দায়ী।
নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনা এবং কোচবিহার জেলায় সৌর-বিদ্যুৎ হাইব্রিড পাম্পের পাইলট প্রকল্প চালু হয়েছে। নদীয়ার সুত্রাগড় এলাকার চর হরিপুর গ্রামে ১৩টি হাইব্রিড পাম্প স্থাপিত হয়েছে, যার প্রতিটি ৫ এইচপি ক্ষমতার এবং ৬ হেক্টর জমির সেচের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রকল্প রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (RKVY)-RAFTAAR প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে খুব কম কৃষকই ৬ হেক্টর জমির মালিক, তাই প্রশাসন কৃষকদের জল ব্যবহারকারী সমিতি গঠন করতে সাহায্য করেছে।
সৌর পাম্পের আরেকটি সুবিধা হলো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ গ্রিডে বিক্রি করার সুযোগ। গ্রিড-সংযুক্ত সৌর পাম্প ব্যবহারকারী কৃষকরা অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ডিসকম-এর কাছে বিক্রি করে অতিরিক্ত আয় করতে পারেন। এটি শুধু সেচ খরচই কমায় না, কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষাও বাড়ায়। তবে, বিশেষজ্ঞ অদিতি মুখার্জি জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে গ্রিড-সংযুক্ত পাম্পের ব্যবহার এখনও খুবই কম। তিনি বলেন, “গ্রিড-সংযুক্ত পাম্পই ভবিষ্যৎ। এটি কৃষকদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ দেয় এবং ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত ব্যবহার রোধ করে।”
তবে, সৌর পাম্পের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগ, সচেতনতার অভাব এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ঘাটতি অনেক কৃষককে এই প্রযুক্তি গ্রহণে নিরুৎসাহিত করে। সঞ্জিত বিশ্বাসের মতো কৃষকরা বলেন, “প্রায় ১ লক্ষ টাকার প্রাথমিক খরচ এবং দুই বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করা অনেক কৃষকের জন্য কঠিন।” এছাড়া, রাত্রে বা মেঘলা দিনে সৌর পাম্পের কার্যকারিতা কমে যায়, যার জন্য হাইব্রিড পাম্প (সৌর ও বিদ্যুৎ) বেশি কার্যকর বলে মনে করেন অনেকে।
এস এম সেহগল ফাউন্ডেশনের মতো এনজিও-রা কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে এবং ভর্তুকি পেতে সহায়তা করছে। তারা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রযুক্তি প্রয়োগে সহায়তা দিচ্ছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গে সৌর পাম্পের ব্যবহার বাড়াতে আরও বেশি সরকারি উদ্যোগ এবং সচেতনতা প্রয়োজন।
সামগ্রিকভাবে, সৌর পাম্প পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এটি কেবল সেচ ব্যয় কমাচ্ছে না, বরং ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে এবং পরিবেশ রক্ষা করে কৃষকদের জীবনমান উন্নত করছে। যদি রাজ্য সরকার PM-KUSUM প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে এবং কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায়, তবে এই প্রযুক্তি পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে বিপ্লব আনতে পারে।