ভারতের কৃষি খাতে নতুন একটি সংকট দেখা দিয়েছে। ২০২৫ সালের বপন মরশুমের আগে বীজের দাম (Seed Costs) অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, বিশেষ করে ধান, গম, এবং সবজি চাষের সাথে যুক্ত কৃষকরা, এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছেন। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, গত দুই বছরে বীজের দাম প্রায় ১৫-২০% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষকদের জন্য একটি বড় আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে হাইব্রিড ধানের বীজের দাম প্রতি কিলোগ্রামে ২৫০-৩০০ টাকা ছিল, যা এ বছর ৩৫০-৪০০ টাকায় পৌঁছেছে। একইভাবে, সবজি বীজ, যেমন টমেটো, বেগুন এবং ফুলকপির বীজের দামও গড়ে ১০-১৫% বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, যা বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের খরচ বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় উন্নতমানের বীজের সরবরাহ কমে গেছে। তৃতীয়ত, বীজ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি তাদের গবেষণা ও উন্নয়ন খরচের কারণে দাম বাড়িয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা এই পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রাজ্যের বর্ধমান, হুগলি এবং মুর্শিদাবাদের মতো কৃষি-নির্ভর জেলাগুলিতে কৃষকরা জানিয়েছেন যে বীজের দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের উৎপাদন খরচ প্রায় ২৫% বেড়েছে। একজন কৃষক, বর্ধমানের অমর সাঁতরা, বলেন, “আগে আমরা এক বিঘা জমির জন্য ধানের বীজে ২,০০০ টাকা খরচ করতাম। এখন তা ৩,০০০ টাকার বেশি হয়ে গেছে। এর সাথে সার, কীটনাশক, এবং শ্রমিকের খরচ যোগ হচ্ছে। লাভ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি কেবল কৃষকদেরই নয়, সাধারণ মানুষের উপরও প্রভাব ফেলবে। বীজের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলের দামও বাড়তে পারে। ফলে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ছে। ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, এবং বীজের দাম বৃদ্ধি এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
সরকার এই সমস্যা মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষকদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত বীজ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এই সুবিধা সব কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এছাড়া, কৃষি মন্ত্রণালয় জাতীয় বীজ নীতির অধীনে উন্নতমানের বীজের সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তবে, এই উদ্যোগগুলি এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। কৃষক সংগঠনগুলি সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে যে বীজের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক এবং সরকারি ভর্তুকি আরও বাড়ানো হোক।
এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের জন্য বিকল্প সমাধানও প্রয়োজন। কৃষি বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে কৃষকরা স্থানীয় এবং ঐতিহ্যবাহী বীজ ব্যবহার করতে পারেন, যা তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম। তবে, এই বীজগুলির উৎপাদনশীলতা হাইব্রিড বীজের তুলনায় কম হওয়ায় কৃষকরা এই বিকল্পে আগ্রহী হচ্ছেন না। এছাড়া, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও সাশ্রয়ী এবং উচ্চ ফলনশীল বীজ উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে।
কৃষকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এই সমস্যার গভীরতা তুলে ধরছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক সংগঠনগুলি ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারের কাছে তাদের দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, যদি বীজের দাম নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে অনেক কৃষক চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। এটি কেবল কৃষি অর্থনীতির জন্যই নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বীজের মূল্যবৃদ্ধি শুধু কৃষকদের জন্যই নয়, পুরো কৃষি ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। সরকার, বীজ উৎপাদনকারী সংস্থা এবং কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ২০২৫ সালের বপন মরশুমে কৃষকরা যাতে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেন, তার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।
For more updates, follow Kolkata24x7 on Facebook, Twitter, Instagram, Youtube; join our community on Whatsapp