পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ কৃষকদের উপর ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ভারী প্রভাব

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলের কৃষকরা ডিজেলের ক্রমবর্ধমান মূল্যের (Rising Diesel Prices) কারণে তীব্র আর্থিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। কৃষি কাজে ট্রাক্টর, পাম্প এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য…

Rising Diesel Prices in 2025 Hit Tractor Owners Hard in Rural West Bengal

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলের কৃষকরা ডিজেলের ক্রমবর্ধমান মূল্যের (Rising Diesel Prices) কারণে তীব্র আর্থিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। কৃষি কাজে ট্রাক্টর, পাম্প এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য ডিজেলের উপর নির্ভরশীল এই কৃষকদের জন্য, ডিজেলের দাম বৃদ্ধি কৃষি ব্যয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদন খরচই বাড়ায়নি, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির চাপও সৃষ্টি করছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি-নির্ভর অঞ্চলগুলিতে, যেমন পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, নদিয়া, হুগলি এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এই সমস্যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।

ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বর্তমান চিত্র
আলিপুর আবহাওয়া দফতর এবং অন্যান্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গে ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৯১.১৩ টাকায় পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এই বছরের শুরুতে ডিজেলের দাম ৯২.৫৫ টাকা থেকে ৯৩.২০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে, যা গত পাঁচ মাসে প্রায় ২.১৩-২.৩৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। কলকাতায় ডিজেলের দাম গত মে মাসে ৯১.৮২ টাকায় স্থিতিশীল ছিল, কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় স্থানীয় কর এবং পরিবহন খরচের কারণে দাম কিছুটা বেশি। এই মূল্যবৃদ্ধির পিছনে আন্তর্জাতিক অপরিশোধিত তেলের দাম, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যহ্রাস, এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির ভূমিকা রয়েছে।

   

কৃষকদের উপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি কার্যক্রমে ডিজেলের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাক্টর, সেচ পাম্প এবং ফসল পরিবহনের জন্য ডিজেল-চালিত যানবাহন ব্যবহৃত হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭১.৪% সেচ কার্যক্রম ডিজেল পাম্পের উপর নির্ভরশীল। একজন কৃষকের জন্য প্রতি একর জমি চাষে গড়ে ৪৮-৫৭ লিটার ডিজেল প্রয়োজন, যার মধ্যে চাষ, ফসল পরিবহন এবং সেচের কাজ অন্তর্ভুক্ত। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রতি একরে গড়ে ১,০০০-১,৫০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, যা কৃষকদের লাভের মার্জিনকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করছে।

নদিয়ার কৃষক রমেশ মণ্ডল বলেন, “গত বছর ডিজেলের দাম ছিল ৮৮ টাকার কাছাকাছি, কিন্তু এখন প্রতি লিটারে ৩-৪ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। আমার ৫ একর জমির জন্য ট্রাক্টর ও পাম্প চালাতে এখন মাসে ১০,০০০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে।” এই অতিরিক্ত খরচ কৃষকদের ফসলের দাম বাড়াতে বাধ্য করছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের উপর মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করছে।

গ্রামীণ মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব
ডিজেলের দাম বৃদ্ধি শুধুমাত্র কৃষি খরচই বাড়ায়নি, বরং পরিবহন ব্যয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ পণ্য পরিবহন ডিজেল-চালিত ট্রাকের মাধ্যমে হয়। ফলে, ফসল, সবজি এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পটেটো এবং ধানের মতো প্রধান ফসলের পরিবহন খরচ গত এক বছরে প্রায় ১০-১৫% বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি শহরাঞ্চলের বাজারেও প্রভাব ফেলছে, যেখানে ভোক্তারা উচ্চ মূল্যে খাদ্যপণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) এই মুদ্রাস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু এটি কৃষকদের জন্য ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রামীণ কৃষকরা, যারা প্রায়শই কৃষি ঋণের উপর নির্ভরশীল, এখন উচ্চ সুদের হার এবং ডিজেলের বর্ধিত খরচের দ্বৈত চাপের সম্মুখীন।

Advertisements

সরকারি উদ্যোগ এবং সমাধানের সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের জন্য বিভিন্ন ভর্তুকি এবং সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকি প্রকল্প এবং কৃষি ঋণে স্বল্প সুদের হার প্রদান করা হচ্ছে। তবে, এই প্রকল্পগুলি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবকে পুরোপুরি প্রশমিত করতে পারছে না। কৃষকরা দাবি করছেন যে ডিজেলের উপর রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় শুল্ক কমানো হোক, যাতে তাদের উৎপাদন খরচ হ্রাস পায়।

এছাড়া, কিছু কৃষক বিকল্প শক্তির উৎস, যেমন সৌরশক্তি-চালিত পাম্প এবং বৈদ্যুতিক ট্রাক্টরের দিকে ঝুঁকছেন। ২০২৪ সালে ভারতের ট্রাক্টর বাজার ৭.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, এবং বৈদ্যুতিক ট্রাক্টরের চাহিদা বাড়ছে। তবে, এই প্রযুক্তির উচ্চ প্রাথমিক খরচ এবং গ্রামীণ এলাকায় সীমিত বিদ্যুৎ অবকাঠামো এই রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করছে।

কৃষকদের অভিযোগ এবং প্রতিক্রিয়া
পূর্ব মেদিনীপুরের কৃষক সমীর জানা বলেন, “ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে আমাদের লাভ কমে গেছে। সরকার ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP) বাড়িয়েছে, কিন্তু তা ডিজেল এবং সারের খরচ মেটাতে যথেষ্ট নয়।” অনেক কৃষক সরকারের কাছে ডিজেলের উপর ভর্তুকি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় শ্রমিকের ঘাটতি এবং উচ্চ মজুরির কারণে কৃষকদের ট্রাক্টরের উপর নির্ভরতা বেড়েছে, যা ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবকে আরও তীব্র করেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ক্রিসিল রেটিংসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ সালে ভারতের ট্রাক্টর বিক্রি ৯.৭৫ লাখ ইউনিটে পৌঁছতে পারে, যা গত বছরের তুলনায় ৩-৫% বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধির পিছনে সরকারের কৃষি সহায়তা, উচ্চ MSP, এবং উন্নত মৌসুমের প্রত্যাশা ভূমিকা রাখছে। তবে, ডিজেলের দাম বৃদ্ধি এবং TREM V নির্গমন নিয়মের কারণে ট্রাক্টরের দাম ১০-২০% বাড়তে পারে, যা কৃষকদের জন্য আরও চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ কৃষকরা ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপের সম্মুখীন। এই বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদন খরচ বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রামীণ মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করছে। সরকারের ভর্তুকি এবং বিকল্প শক্তির উৎসের প্রচলন এই সমস্যা কিছুটা প্রশমিত করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষি অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক সম্প্রদায় এখন সরকারের কাছে আরও কার্যকর নীতি এবং সহায়তার আশা করছে, যাতে তারা এই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।