কালো নুনিয়ার পুনরুজ্জীবন! পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ধানের জাত পুনরুদ্ধারে যাত্রা

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ঐতিহ্যে ধানের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এই রাজ্য একসময় ৫,৫০০টিরও বেশি দেশীয় ধানের জাতের জন্য বিখ্যাত ছিল, যা শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নয়, বাঙালির…

Reviving Kalo Nunia Rice: West Bengal’s Mission to Restore Indigenous Rice Varieties for Sustainability

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ঐতিহ্যে ধানের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এই রাজ্য একসময় ৫,৫০০টিরও বেশি দেশীয় ধানের জাতের জন্য বিখ্যাত ছিল, যা শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নয়, বাঙালির সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তবে, সবুজ বিপ্লবের পর উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত (HYVs) এবং বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় বাসমতি ধানের আধিপত্যের কারণে এই দেশীয় জাতগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষক, বিজ্ঞানী এবং সংরক্ষণবাদীরা একযোগে কাজ শুরু করেছেন কালো নুনিয়া (Kalo Nunia Rice) সহ ঐতিহ্যবাহী ধানের জাতগুলির পুনরুজ্জীবনের জন্য। এই প্রতিবেদনে আমরা কালো নুনিয়ার পুনরুত্থান, এর গুরুত্ব এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষি জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করব।

কালো নুনিয়া: ঐতিহ্যের একটি রত্ন
কালো নুনিয়া, যা কালা নেনিয়া, কালা নিনা বা কালা নুনিয়াহ নামেও পরিচিত, পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলার কিছু অংশে প্রধানত চাষ করা হয়। এই ধানের জাতটি তার কালো রঙের খোসা এবং সুগন্ধযুক্ত, নন-স্টিকি টেক্সচারের জন্য বিখ্যাত। নামটি বাংলা শব্দ ‘কালো’ (কালো রঙ) এবং ‘নুনিয়া’ (পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় ধানের গ্রুপ) থেকে এসেছে। ২০২৪ সালে, কালো নুনিয়া ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) ট্যাগ পায়, যা এটিকে উত্তরবঙ্গের একটি এক্সক্লুসিভ ধানের জাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় ধানের জাত হিসেবে GI ট্যাগ পেয়েছে, তুলাইপাঞ্জি এবং গোবিন্দভোগের পরে।

   

কালো নুনিয়ার ফলন কম হলেও এটি জলবায়ু পরিবর্তন, কীটপতঙ্গ এবং রোগের বিরুদ্ধে অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করে। এই ধানের জাত কম সারের প্রয়োজন হয় এবং জৈব চাষের জন্য আদর্শ। এর পুষ্টিগুণও উল্লেখযোগ্য—এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, আয়রন, জিঙ্ক এবং ভিটামিন বি, যা এটিকে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী করে তোলে। এই ধানটি প্রধানত পায়েস, পোলাও, বিরিয়ানি এবং পিঠার মতো ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যা বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা: কৃষক ও সংস্থার ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ধানের জাত পুনরুদ্ধারে বেশ কয়েকটি সংস্থা এবং ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফোরাম ফর ইন্ডিজেনাস অ্যাগ্রিকালচারাল মুভমেন্ট (FIAM) উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় ২০১১ সাল থেকে কাজ শুরু করে। এই সংস্থাটি ৫.৫ বিঘা জমিতে মাত্র ১০টি জাত নিয়ে শুরু করলেও, বর্তমানে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে ১০০টিরও বেশি দেশীয় ধানের জাত চাষ করছে। ২০১৮ সালের মধ্যে তারা ১৫০ বিঘা জমিতে ১২০টি জাত চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।

উত্তর দিনাজপুরের হাটিয়াপালুইবাড়ি গ্রামের মধু দাস, একজন কম্পিউটার পেশাদার, শহরে চাকরির পরিবর্তে গ্রামে ফিরে এসে দেশীয় ধান চাষে নিয়োজিত হয়েছেন। তিনি বলেন, “কৃষকদের আত্মহত্যার খবর, ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলের ক্ষতি আমাকে দেশীয় ধানের জাত পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করেছে।” একইভাবে, দক্ষিণ দিনাজপুরের নকাইর গ্রামের সেলিম সরকার তার পূর্বপুরুষের জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাকে একীভূত করে জৈব চাষের মাধ্যমে কালো নুনিয়া, রাধাতিলক, তুলসীমুকুল, গোবিন্দভোগের মতো জাত চাষ করছেন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এই প্রচেষ্টায় সমর্থন দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ বায়োডাইভার্সিটি বোর্ড (WBBB) ২৫০টি দেশীয় ধানের জাত সংগ্রহ করেছে এবং বীরভূমের বলপুর, বাঁকুড়ার হীরবাঁধ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়গোপালপুর ও কুলতলি এবং পূর্ব মেদিনীপুরের দাঁতনে বীজ ব্যাঙ্ক তৈরি করেছে। এই বীজ ব্যাঙ্কগুলি থেকে ২৫টি জাত ১৩০ বিঘা জমিতে ৯০ জন কৃষকের মাধ্যমে চাষ করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মেদিনীপুরের কবিরাজ সাল এবং বাঁকুড়ার দানাগুড়ি জাত, যা জিঙ্ক, আয়রন এবং ভিটামিন বি সমৃদ্ধ, পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।

Advertisements

কেন এই পুনরুজ্জীবন গুরুত্বপূর্ণ?
কালো নুনিয়ার মতো দেশীয় ধানের জাত শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নিশ্চিত করে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম। এই জাতগুলি কম রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োজন হয়, যা পরিবেশের উপর কম চাপ সৃষ্টি করে। নদিয়ার কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (ATC) সহকারী পরিচালক অনুপম পাল জানান, “এই ধানের জাতগুলি মাটি ও অঞ্চলভিত্তিক, যা জৈব সার এবং কীটনাশকের মাধ্যমে চাষ করা হয়। এগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নতুন কীটপতঙ্গ এবং রোগের বিরুদ্ধে বেশি প্রতিরোধী।” তিনি ৪০০টিরও বেশি দেশীয় ধানের জাত সংরক্ষণ করেছেন, যার মধ্যে কালো নুনিয়া অন্যতম।

এছাড়া, এই ধানের জাতগুলি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, কালো নুনিয়ায় উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট রয়েছে, যা হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। এই জাতগুলি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন পায়েস, খিচুড়ি এবং পিঠার স্বাদ বাড়ায়, যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত।

চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
দেশীয় ধানের জাত পুনরুজ্জীবনের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই জাতগুলির ফলন তুলনামূলকভাবে কম (২-২.৫ টন/হেক্টর), যা উচ্চ ফলনশীল জাতের (৮.৪৮ টন/হেক্টর পর্যন্ত) তুলনায় অনেক কম। এছাড়া, বাজারজাতকরণের অভাব এবং ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি এই জাতগুলির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বাধা। তবে, FIAM এবং WBBB-এর মতো সংস্থাগুলি সোশ্যাল মিডিয়া এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই ধানের প্রচার করছে। উদাহরণস্বরূপ, তুলাইপাঞ্জি এবং কালো নুনিয়ার মতো জাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশ্ব বাংলা স্টোর এবং রেস্তোরাঁগুলিতে এই ধানের জাতের প্রচার বাড়ছে। কলকাতার শেফরা কালো নুনিয়া, গোবিন্দভোগ এবং তুলাইপাঞ্জির মতো জাত ব্যবহার করে উদ্ভাবনী খাবার তৈরি করছেন, যেমন কালো ধানের কেক এবং রিসোটো। এছাড়া, ঝাড়গ্রামের মহিলা কৃষকরা জৈব কালো ধান চাষ করে বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকার ব্যবসা করছেন, যা তাদের আর্থিক স্বাধীনতা দিচ্ছে।

কালো নুনিয়ার পুনরুজ্জীবন পশ্চিমবঙ্গের কৃষি জৈববৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এই ধানের জাত শুধু পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে টেকসই কৃষির একটি সমাধানও বটে। কৃষক, বিজ্ঞানী এবং সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, কালো নুনিয়া এবং অন্যান্য দেশীয় ধানের জাত বাঙালির পাতে ফিরে আসছে। তবে, এই প্রচেষ্টাকে আরও ব্যাপক করতে ভোক্তা সচেতনতা এবং বাজারজাতকরণের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। কালো নুনিয়ার এই পুনরুত্থান শুধু কৃষি নয়, বাঙালির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের গল্প।