পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর (মনসুন) বিলম্বিত আগমন এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ২০২৫ সালের খরিফ ফসল (Kharif Crop) বপনের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। ধান, ভুট্টা, ডাল, তৈলবীজ এবং তুলার মতো খরিফ ফসল, যা মূলত জুন থেকে জুলাই মাসে বপন করা হয়, পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানিয়েছে যে, ২০২৫ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টিপাত গড়ে ২০-৩১% কম হয়েছে, যা রাজ্যের কৃষকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিলম্ব কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি অর্থনীতির উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
বিলম্বিত মনসুনের প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের শীর্ষস্থানীয় ধান উৎপাদনকারী রাজ্যগুলির মধ্যে একটি, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ১৪.৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়। খরিফ মৌসুমে রাজ্যের ধান উৎপাদনের প্রায় ৭০% হয়। তবে, ২০২৫ সালে মনসুনের বিলম্ব এবং জুন মাসে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ধান বপনের কাজকে ব্যাহত করেছে। আইএমডি-র তথ্য অনুসারে, রাজ্যের বর্ধমান, হুগলি, এবং নদিয়ার মতো প্রধান কৃষি জেলাগুলিতে বৃষ্টিপাত ৩১% পর্যন্ত কম হয়েছে। এই পরিস্থিতি কৃষকদের ধানের চারা রোপণ এবং অন্যান্য খরিফ ফসল যেমন তুলা, মুগ, এবং সয়াবিন বপনে বাধা সৃষ্টি করছে।
বর্ধমান জেলার একজন কৃষক, সুব্রত মণ্ডল, বলেন, “জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে ধানের চারা রোপণে সমস্যা হবে। আমরা ইতিমধ্যেই বপনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি, কিন্তু মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকায় কাজ শুরু করতে পারিনি।” এই ধরনের পরিস্থিতি রাজ্যের অনেক কৃষকের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে, কারণ খরিফ ফসলের উৎপাদনশীলতা মনসুনের সময়মতো আগমন এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল।
খরিফ ফসলের উপর প্রভাব
খরিফ ফসল, যা মনসুনের বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল, বিলম্বিত বৃষ্টির কারণে উৎপাদনশীলতায় ঝুঁকির সম্মুখীন। ধান, যা পশ্চিমবঙ্গের প্রধান খরিফ ফসল, রোপণের সময় ১০ সেন্টিমিটার গভীরতায় জলাবদ্ধ ক্ষেত্র প্রয়োজন। বৃষ্টির অভাবে চারা রোপণ বিলম্বিত হলে ফসলের বৃদ্ধি পর্যায়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা ফলন হ্রাসের কারণ হতে পারে। এছাড়াও, মুগ, উড়দ, এবং সয়াবিনের মতো ডাল এবং তৈলবীজ ফসলের বপনও বিলম্বিত হচ্ছে, যা কৃষকদের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
২০২৫ সালের জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ধান বপন ৪.৫৩ লক্ষ হেক্টরে হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ৪.০০ লক্ষ হেক্টরের তুলনায় কিছুটা বেশি। তবে, এটি স্বাভাবিক খরিফ ধান বপনের এলাকা ৪০৩.০৯ লক্ষ হেক্টরের তুলনায় এখনও অনেক কম। এই বিলম্বের ফলে কৃষকরা স্বল্পমেয়াদী ফসলের দিকে ঝুঁকছেন অথবা পর্যাপ্ত মাটির আর্দ্রতার জন্য অপেক্ষা করছেন।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
বিলম্বিত মনসুন শুধুমাত্র কৃষকদের উপরই প্রভাব ফেলছে না, বরং রাজ্যের কৃষি অর্থনীতির উপরও চাপ সৃষ্টি করছে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষি খাত রাজ্যের অর্থনীতির প্রায় ১৯.৫% অবদান রাখে, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি। খরিফ ফসলের ফলন হ্রাস পেলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে, যা সাধারণ ভোক্তাদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে অনিয়মিত মনসুনের কারণে ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে খুচরা শস্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এছাড়াও, কৃষকদের মধ্যে আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অনেক কৃষক ঋণের উপর নির্ভরশীল, এবং ফসলের ক্ষতি তাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করতে পারে। কৃষি বিশেষজ্ঞ প্রণব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিলম্বিত মনসুন কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়, কারণ তাদের সেচের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় অথবা পুনরায় বপনের প্রয়োজন হয়।”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি খাতের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, “তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা এবং সমর্থন মূল্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। মনসুনের বিলম্বের প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের কোনও পরিকল্পনা নেই।” এই পরিস্থিতি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
কৃষকদের কৌশল এবং সরকারি পদক্ষেপ
বিলম্বিত মনসুনের প্রভাব মোকাবিলায় কৃষকরা স্বল্পমেয়াদী ফসল যেমন মুগ এবং উড়দের দিকে ঝুঁকছেন, যা কম সময়ে এবং কম পানির প্রয়োজনে ফলন দেয়। এছাড়াও, কিছু কৃষক সেচের উপর নির্ভর করছেন, যদিও রাজ্যের সেচ ব্যবস্থা সীমিত। আইএমডি কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে যে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্যাপ্ত মাটির আর্দ্রতা না হলে বপন বিলম্বিত করা উচিত।
রাজ্য সরকার কৃষকদের সহায়তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষি মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমরা কৃষকদের জন্য বীজ এবং সারের উপর ভর্তুকি বাড়িয়েছি। এছাড়াও, সেচ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রকল্প চালু করা হয়েছে।” তবে, কৃষক সংগঠনগুলি দাবি করছে যে, এই পদক্ষেপগুলি অপর্যাপ্ত এবং আরও ব্যাপক সহায়তার প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মনসুনের ধরণে পরিবর্তন এই ধরনের বিলম্বের একটি প্রধান কারণ। গত ৩০ বছরের আইএমডি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের ৬২% জেলায় জুন মাসে বৃষ্টিপাত কমেছে। এই পরিবর্তন কৃষকদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, যারা ঐতিহ্যগতভাবে মনসুনের উপর নির্ভর করে ফসল বপনের সময় নির্ধারণ করে।
পশ্চিমবঙ্গে ২০২৫ সালে মনসুনের বিলম্ব খরিফ ফসল বপনের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে ধান, ডাল, এবং তৈলবীজ ফসলের ক্ষেত্রে। এই পরিস্থিতি কৃষকদের আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি তৈরি করছে। রাজ্য সরকারের উপর কৃষকদের সহায়তার জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি অত্যন্ত জরুরি। আগামী দিনে মনসুনের অগ্রগতি এবং সরকারি হস্তক্ষেপ কৃষকদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সাহায্য করবে, তা নির্ধারণ করবে রাজ্যের কৃষি খাতের ভবিষ্যৎ।