কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক কৃষি (Contract Farming) ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে কৃষকদের জন্য নিরাপদ আয় নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এই পদ্ধতিতে কৃষকরা কোনও কোম্পানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ সংস্থা বা ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করে নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদন করেন, যেখানে ফসলের দাম, পরিমাণ এবং গুণমান আগেই নির্ধারিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। তবে, এই পদ্ধতির সুবিধা এবং অসুবিধা উভয়ই রয়েছে, যা কৃষকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিবেচনা করা উচিত।
চুক্তিভিত্তিক কৃষির সুবিধা
নিরাপদ আয়ের নিশ্চয়তা: কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল কৃষকদের জন্য নির্ধারিত দামে ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা। বাজারে দামের ওঠানামার ঝুঁকি থেকে কৃষকরা মুক্ত থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে আলু, টমেটো এবং ফুলকপির মতো ফসলের জন্য খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ সংস্থাগুলো কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করে, যা তাদের আয়ের স্থিতিশীলতা দেয়।
উন্নত প্রযুক্তি ও সম্পদের প্রাপ্তি: কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর মাধ্যমে কৃষকরা উন্নত বীজ, সার, এবং কৃষি প্রযুক্তির সুবিধা পান। অনেক কোম্পানি কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তাও প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও হুগলি জেলায় বেশ কিছু কৃষক পোলট্রি এবং মাশরুম চাষে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছেন।
বাজারের সংযোগ: কন্ট্রাক্ট ফার্মিং কৃষকদের সরাসরি বাজারের সঙ্গে যুক্ত করে। মধ্যস্থতাকারীদের বাদ দিয়ে কৃষকরা তাদের ফসল সরাসরি কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারেন, যা তাদের লাভের পরিমাণ বাড়ায়।
ঝুঁকি হ্রাস: প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাজারের অস্থিরতার কারণে কৃষকদের ক্ষতির ঝুঁকি কমে। চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিগুলো প্রায়ই ফসল বীমা বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে।
চুক্তিভিত্তিক কৃষির অসুবিধা
স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা: কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এ কৃষকদের ফসল নির্বাচন, চাষের পদ্ধতি এবং বিক্রির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা হ্রাস পায়। কোম্পানি নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদনের শর্ত আরোপ করে, যা কৃষকদের পছন্দের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে।
চুক্তির শর্তের জটিলতা: অনেক কৃষক চুক্তির শর্ত ভালোভাবে বুঝতে পারেন না, যার ফলে কোম্পানিগুলো তাদের শোষণ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু কৃষক অভিযোগ করেছেন, কোম্পানিগুলো গুণমানের অজুহাতে ফসল প্রত্যাখ্যান করে বা কম দাম দেয়।
ঋণের ফাঁদ: কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশি হতে পারে। অনেক কৃষক কোম্পানির কাছ থেকে ঋণ নেন, যা ফসল ব্যর্থ হলে তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলতে পারে।
বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ: কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর মাধ্যমে বড় কোম্পানিগুলো কৃষকদের উপর নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পারে। কৃষকরা কোম্পানির শর্ত মানতে বাধ্য হন, যা তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা হ্রাস করে।
পশ্চিমবঙ্গে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং
পশ্চিমবঙ্গে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং প্রধানত আলু, মাশরুম, পোলট্রি এবং ফলের চাষে জনপ্রিয়। বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুরের মতো জেলায় কৃষকরা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ সংস্থা এবং রপ্তানিকারকদের সঙ্গে চুক্তি করছেন। তবে, কিছু কৃষক অভিযোগ করেছেন যে কোম্পানিগুলো প্রায়ই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে বা ফসলের গুণমান নিয়ে সমস্যা তুলে কম দাম দেয়।
ছুটবে বিদেশিহীন পাল-তোলা নৌকা! ডুরান্ডের অভিযান শুরুতেই বাগানের কাঁটা মহামেডান
সরকারি উদ্যোগ
ভারত সরকার ২০২০ সালে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংকে উৎসাহিত করতে ‘কৃষি উৎপাদন বাণিজ্য ও প্রচার (প্রমোশন এবং ফ্যাসিলিটেশন) অধ্যাদেশ’ পাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও কৃষকদের জন্য কন্ট্রাক্ট ফার্মিং প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা কর্মসূচি চালু করেছে। তবে, কৃষকদের জন্য স্বচ্ছ চুক্তি এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিং কৃষকদের জন্য নিরাপদ আয় এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সুযোগ প্রদান করে, তবে এর সঙ্গে স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা এবং শোষণের ঝুঁকিও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য এই পদ্ধতি লাভজনক হতে পারে, তবে চুক্তির শর্ত স্পষ্ট বোঝা এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, কৃষক এবং কোম্পানির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিং কৃষি অর্থনীতির জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে।