প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা (PMFBY), ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কর্তৃক চালু করা, ভারতের কৃষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী ফসল বীমা প্রকল্প। এই প্রকল্পের লক্ষ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কীটপতঙ্গের আক্রমণ এবং রোগের কারণে ফসলের ক্ষতি থেকে কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করা। ২০২৫ সালে এই প্রকল্পের নয় বছর পূর্ণ হয়েছে, এবং এটি ভারতের বৃহত্তম কৃষি বীমা প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। তবে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য এই প্রকল্প কতটা কার্যকর? এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গে PMFBY-এর কার্যকারিতা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
PMFBY-এর মূল বৈশিষ্ট্য
প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী বীমা প্রিমিয়াম এবং ব্যাপক কভারেজ প্রদান করে। খরিফ ফসলের জন্য কৃষকদের প্রিমিয়াম মাত্র ২%, রবি ফসলের জন্য ১.৫% এবং বাণিজ্যিক ও উদ্যান ফসলের জন্য ৫%। বাকি প্রিমিয়াম কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সমানভাবে ভর্তুকি দেয়। এই প্রকল্পটি খরা, বন্যা, ঝড়, শিলাবৃষ্টি, কীটপতঙ্গের আক্রমণ এবং রোগের কারণে ফসলের ক্ষতি কভার করে। এছাড়া, ফসল কাটার পর দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ক্ষতি, যেমন ঝড় বা অসময়ের বৃষ্টির কারণে ক্ষতি, এই প্রকল্পের আওতায় পড়ে। প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন স্যাটেলাইট ইমেজিং, ড্রোন এবং মোবাইল অ্যাপ, ক্ষতি মূল্যায়ন এবং দ্রুত দাবি নিষ্পত্তির জন্য গৃহীত হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে PMFBY-এর বাস্তবায়ন
পশ্চিমবঙ্গে PMFBY ২০১৬ সাল থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তবে এই প্রকল্প থেকে রাজ্যটি ২০২০ সালে সরে আসে। রাজ্য সরকার আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং কম দাবি নিষ্পত্তির হারের কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজ্য আবার এই প্রকল্পে যোগ দেয়, কারণ কৃষকদের মধ্যে ফসল বীমার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, বিশেষ করে ধান, পাট, আলু এবং উদ্যান ফসল চাষিরা, এই প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন। তবে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫ লক্ষ কৃষক এই প্রকল্পে নথিভুক্ত হয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ২৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে, কৃষকরা প্রিমিয়াম হিসেবে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা প্রদান করেছেন, এবং ১,৮০০ কোটি টাকার দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে, এই দাবি নিষ্পত্তির হার এখনও অনেক কৃষকের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। মোট কৃষকের মধ্যে প্রায় ৪২% অ-ঋণী কৃষক, যারা স্বেচ্ছায় এই প্রকল্পে যোগ দিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য কার্যকারিতা
পশ্চিমবঙ্গে PMFBY-এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে গেলে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। প্রথমত, এই প্রকল্প কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের খরা এবং অসময়ের বৃষ্টির কারণে দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদার কৃষকরা উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। PMFBY-এর মাধ্যমে এই কৃষকরা তাদের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, যা তাদের ঋণের ফাঁদে পড়া থেকে রক্ষা করেছে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পটি কৃষকদের আধুনিক কৃষি পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করছে। প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন ফসল কাটার পরীক্ষা (Crop Cutting Experiments) এবং স্যাটেলাইট ইমেজিং, ক্ষতি মূল্যায়নকে আরও স্বচ্ছ করেছে।
তবে, পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে কিছু অভিযোগ রয়েছে। প্রথমত, দাবি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় বিলম্ব একটি বড় সমস্যা। ২০২৩-২৪ মৌসুমে, প্রায় ৪০% কৃষক এখনও তাদের দাবির টাকা পাননি। এই বিলম্ব কৃষকদের আর্থিক সংকটে ফেলছে। দ্বিতীয়ত, বীমা কোম্পানি, ব্যাংক এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন যে তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে কারণ তথ্য সঠিকভাবে আপলোড করা হয়নি। তৃতীয়ত, ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রকল্পে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া জটিল। অনেক কৃষকের কাছে প্রয়োজনীয় নথি, যেমন জমির রেকর্ড বা কিষান ক্রেডিট কার্ড, নেই।
পশ্চিমবঙ্গের চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গে PMFBY-এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, রাজ্যের কৃষি ব্যবস্থা বৃষ্টিনির্ভর, যা খরা, বন্যা এবং ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, রাজ্যে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের সংখ্যা বেশি, যারা প্রায়শই প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কারণে প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তৃতীয়ত, সচেতনতার অভাব একটি বড় সমস্যা। অনেক কৃষক এখনও জানেন না কীভাবে এই প্রকল্পে নথিভুক্ত করতে হয় বা কীভাবে দাবি দাখিল করতে হয়।
মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে PMFBY-এর সমালোচনা হয়েছে যে এটি বীমা কোম্পানিগুলির জন্য বেশি লাভজনক এবং কৃষকদের জন্য কম কার্যকর। পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। কৃষক নেতারা দাবি করেছেন যে বীমা কোম্পানিগুলি প্রায়শই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বা কম ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১-২২ মৌসুমে, পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৬০% দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল, যা কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
সমাধানের পথ
পশ্চিমবঙ্গে PMFBY-এর কার্যকারিতা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, দাবি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে। সরকারের নির্দেশিকা অনুসারে, ফসল কাটার দুই মাসের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তি করা উচিত, কিন্তু এটি প্রায়শই মানা হয় না। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানো দরকার। তৃতীয়ত, ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য নথিভুক্তকরণ প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত। এছাড়া, বীমা কোম্পানি, ব্যাংক এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি।
প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করছে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতির সময়। তবে, দাবি নিষ্পত্তির বিলম্ব, সমন্বয়ের অভাব এবং সচেতনতার ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জগুলি এর কার্যকারিতাকে সীমিত করছে। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই প্রকল্প আরও কার্যকর হতে পারে। ২০২৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য PMFBY-এর সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আরও সক্রিয় পদক্ষেপ প্রয়োজন।