কলকাতা, ৮ অক্টোবর ২০২৫: বাংলার কৃষক সমাজের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানেই আতঙ্ক। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা কিংবা ঝড়—এক মুহূর্তেই বছরের সমস্ত পরিশ্রম ভেস্তে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলার বহু কৃষকের কাছে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (Pradhan Mantri Fasal Bima Yojana – PMFBY) এক বড় ভরসা হয়ে উঠেছে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা: মালদহের কৃষক হরিপদ মণ্ডলের গল্প
মালদহের হবিবপুর ব্লকের চাষি হরিপদ মণ্ডল এ বছর আমন ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু টানা বৃষ্টিতে তার প্রায় অর্ধেক জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়। আগে এমন হলে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তাকে হয়তো অন্য রাজ্যে কাজ করতে যেতে হতো। কিন্তু এবার বিমা যোজনার সুবিধা পেয়েছেন তিনি। তার কথায়,
“প্রায় ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এসেছে। অন্তত সংসারের খরচটা চালাতে পারছি। আগামী মৌসুমে আবার জমি চাষে নামতে সাহস পাচ্ছি।”
বাংলায় কত কৃষক উপকৃত
কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত আর্থিক বছরেই প্রায় ১২.৫ লক্ষ কৃষক পশ্চিমবঙ্গে এই যোজনায় অংশগ্রহণ করেছেন। ধান, আলু, পাট ও সবজি চাষের ক্ষেত্রে সর্বাধিক দাবি উঠেছে। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ মিলিয়ে বাংলার কৃষকরা পেয়েছেন প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা।
যোজনা কীভাবে কাজ করে
এই বিমা প্রকল্পে কৃষকদের খুব সামান্য প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়। যেমন—
- ধান ও গমের মতো খাদ্যশস্যের জন্য কৃষককে মাত্র ২% প্রিমিয়াম দিতে হয়।
- তেলবীজ ও বাণিজ্যিক ফসলের জন্য ৫% প্রিমিয়াম নির্ধারিত।
বাকি খরচ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ভাগ করে বহন করে। ফসল নষ্ট হলে কৃষক সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ক্ষতিপূরণ পান।
বাংলার চ্যালেঞ্জ
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও বাংলার সব কৃষক এই সুবিধার আওতায় আসতে পারেননি। অনেক কৃষক বিমা সংক্রান্ত প্রক্রিয়া বা অনলাইন রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সমস্যায় পড়েন। গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতার অভাবও অন্যতম বাধা।
মুর্শিদাবাদের এক কৃষক সংগঠনের নেতা বলেন, “প্রকল্পটা ভালো। কিন্তু অনেকেই জানেন না কীভাবে নাম লেখাতে হবে। স্থানীয় স্তরে আরও প্রচার প্রয়োজন।”
সরকারের উদ্যোগ
কৃষি দপ্তরের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, ব্লক স্তরে ক্যাম্প করে কৃষকদের নিবন্ধন করানো হচ্ছে। একই সঙ্গে কৃষক বন্ধু কেন্দ্র ও পঞ্চায়েত স্তরে কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকদের সচেতন করা হচ্ছে।
রাজ্য কৃষি দপ্তরের এক আধিকারিক জানান, “আমরা চাই প্রতিটি ছোট কৃষক এই বিমার আওতায় আসুন। কারণ তাদের ক্ষতি হলে তার প্রভাব পড়ে পুরো গ্রামীণ অর্থনীতিতে।”
অর্থনীতির প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমা প্রকল্প শুধু কৃষকদের ক্ষতিপূরণই দেয় না, তাদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ায়। ফলে কৃষকরা ঝুঁকি নিয়ে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ে। বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই যোজনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ইতিবাচক হতে পারে।
বাংলার কৃষকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা যেন দুর্যোগের অন্ধকারে আলোর প্রদীপ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল নষ্ট হলেও পরিবার চালানোর মতো সহায়তা পাচ্ছেন কৃষকেরা। তবে প্রকল্পের আসল সফলতা নির্ভর করবে কতটা কার্যকরভাবে সরকার গ্রামীণ স্তরে সচেতনতা বাড়াতে পারে তার উপর।