দার্জিলিং চা বাগানের শ্রমিকদের জীবন: একটি ছবির মতো প্রবন্ধ

দার্জিলিংয়ের চা বাগান, যা বিশ্বব্যাপী ‘চায়ের শ্যাম্পেন’ হিসেবে খ্যাত, শুধুমাত্র তার স্বাদ ও সুগন্ধের জন্যই নয়, বরং সেখানে কাজ করা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যও বিখ্যাত।…

Photo Essay: A Day in the Life of Darjeeling Tea Pluckers 2025

দার্জিলিংয়ের চা বাগান, যা বিশ্বব্যাপী ‘চায়ের শ্যাম্পেন’ হিসেবে খ্যাত, শুধুমাত্র তার স্বাদ ও সুগন্ধের জন্যই নয়, বরং সেখানে কাজ করা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যও বিখ্যাত। এই ফটো প্রবন্ধে আমরা দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের একটি দিনের জীবনের গল্প তুলে ধরব—তাঁদের কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং জীবনযাত্রার একটি মানবিক চিত্র। এই শ্রমিকরা, যাদের মধ্যে অধিকাংশই মহিলা, দার্জিলিংয়ের চা শিল্পের মেরুদণ্ড। তাঁদের হাতে পড়া দুটি পাতা এবং একটি কুঁড়ি বিশ্বের সেরা চায়ের ভিত্তি তৈরি করে।

একটি দিনের শুরু: ভোরের আলোয়
দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের দিন শুরু হয় ভোরের প্রথম আলোয়। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই চা বাগানগুলিতে শ্রমিকরা, প্রধানত গোর্খা এবং লেপচা সম্প্রদায়ের মহিলারা, সকালে উঠে তাঁদের বাঁশের ঝুড়ি এবং প্লাস্টিকের এপ্রোন নিয়ে বাগানের দিকে রওনা হন। পাহাড়ের খাড়া ঢালে তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে চলাচল করেন, যেন পাহাড়ের ছাগলের মতো। মাকাইবাড়ি চা বাগানের ম্যানেজার সঞ্জয় দাসের মতে, “এই শ্রমিকরা পাহাড়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই খাড়া ঢালে চলাচল তাঁদের কাছে স্বাভাবিক।”

   

প্রতিদিন তাঁদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চা পাতা সংগ্রহের লক্ষ্য থাকে। সাধারণত, প্রতি কিলোগ্রাম চা পাতার জন্য প্রায় ২২,০০০টি কুঁড়ি সংগ্রহ করতে হয়। এই কাজের জন্য তাঁদের দ্রুত এবং দক্ষ হাতের প্রয়োজন, কারণ শুধুমাত্র দুটি পাতা এবং একটি কুঁড়ি (টু লিভস অ্যান্ড এ বাড) সংগ্রহ করা হয়, যা দার্জিলিং চায়ের গুণমান নিশ্চিত করে।

কঠোর পরিশ্রমের পিছনে জীবন
দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের জীবন সহজ নয়। সারা সপ্তাহে ছয় দিন, প্রতিদিন আট ঘণ্টা তাঁরা কাজ করেন। তাঁদের দৈনিক মজুরি প্রায় ২৫০-৩০০ টাকা, যা বিশ্ববাজারে দার্জিলিং চায়ের উচ্চ মূল্যের তুলনায় খুবই কম। উদাহরণস্বরূপ, এক আউন্স ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ চা আন্তর্জাতিক বাজারে ৬০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়, কিন্তু শ্রমিকরা দিনে মাত্র এক ডলারের সামান্য বেশি আয় করেন। এই বৈষম্য নিয়ে বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী সারাহ বেস্কি বলেছেন, “দার্জিলিংয়ের মহিলা শ্রমিকরা বিশ্বের সবচেয়ে দামি চা উৎপাদন করেন, কিন্তু তাঁদের আয় তার সামান্য অংশ মাত্র।”

শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই, যেমন সরস্বতী খাওয়াস, কাছাকাছি গ্রামে বাস করেন। সরস্বতী, যিনি মাত্র এক বছর ধরে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, বলেন, “আমার স্বামী পুনেতে কাজ করেন, কিন্তু আমি এখানে আমার পরিবারের জন্য কাজ করি।” তাঁর মতো অনেক শ্রমিকের সন্তানরা স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করেন, এবং তাঁদের স্বপ্ন তাঁদের সন্তানদের জন্য ভালো ভবিষ্যৎ। উদাহরণস্বরূপ, সঞ্জু বোমজানের মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তিনি বলেন, “আমি চাই আমার সন্তানরা ভালো শিক্ষা পাক।”

চা শ্রমিকদের জীবনে চ্যালেঞ্জ
দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকরা কেবল কঠোর পরিশ্রমই করেন না, তাঁরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। ২০১৭ সালে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে ধর্মঘটের কারণে চা শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় এবং মাটির ক্ষয়ের মতো সমস্যাগুলি চা বাগানের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করছে। কিছু চা বাগান, যেমন মাকাইবাড়ি, জৈব ও বায়োডাইনামিক চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যা পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য অতিরিক্ত আয়ের উৎস তৈরি করেছে।

Advertisements

তবে, শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি এবং জমির মালিকানার অধিকারের দাবি এখনও পূরণ হয়নি। দার্জিলিং জেলা চা কামান মজদুর ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি সমন পাঠক বলেন, “৮৭টি চা বাগানের মধ্যে চার-পাঁচটি পরিত্যক্ত। শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি এবং জমির অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”

মানবিক গল্প: নারী শ্রমিকদের অবদান
দার্জিলিংয়ের চা শিল্পে নারী শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। তাঁরা কেবল চা পাতা সংগ্রহই করেন না, বরং বাগানের বিভিন্ন কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গিলিয়ান রাইট তাঁর বই দ্য ডার্জিলিং টি বুক-এ উল্লেখ করেছেন, “চা বাগানের সাফল্য নির্ভর করে এই নারী শ্রমিকদের উপর, যাঁরা তাঁদের দক্ষতা এবং নিষ্ঠা দিয়ে শিল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।” অনেক শ্রমিক, যেমন রুবিনা বোমজান, তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য কাজ করেন। তাঁদের মেয়ে আনামিকা বলে, “আমি এয়ারহোস্টেস হতে চাই, যাতে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় উড়তে পারি।”

চা শ্রমিকদের জীবনের ছবি
একটি ফটো প্রবন্ধে দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের জীবন ধরা পড়ে রঙিন ছবিতে। সবুজ পাহাড়ের মাঝে তাঁদের রঙিন পোশাক, ঝুড়িতে চা পাতা সংগ্রহের দৃশ্য, এবং তাঁদের হাসিমুখ এই শিল্পের মানবিক দিকটি তুলে ধরে। সিঙ্গেল চা বাগানে তোলা ছবিগুলি দেখায় কীভাবে শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রমের মাঝেও তাঁদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেন। তাঁদের ঝুড়িতে ঝুলন্ত লাঞ্চবক্স, লেমনগ্রাসের সবুজ ছায়া, এবং পাহাড়ের খাড়া ঢালে তাঁদের দক্ষ চলাচল এই প্রবন্ধের প্রাণ।

দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের জীবন একটি মানবিক গল্প, যা পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং স্বপ্নের সমন্বয়। তাঁদের কঠোর পরিশ্রম বিশ্বের সেরা চা উৎপাদন করে, কিন্তু তাঁদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য আরও বেশি প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই ফটো প্রবন্ধ শুধু তাঁদের কাজের চিত্রই তুলে ধরে না, বরং তাঁদের জীবনের আশা, সংগ্রাম এবং সম্প্রদায়ের গল্পও বলে। পরের বার যখন আপনি দার্জিলিং চায়ের কাপে চুমুক দেবেন, তখন এই শ্রমিকদের কথা মনে পড়বে, যাঁদের হাতে তৈরি হয় এই স্বাদের যাদু।