কলকাতা, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫: ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে ২০২৫ সালে কীটনাশক নিষেধাজ্ঞা (Pesticide Ban) নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। পরিবেশ সুরক্ষা, মানব স্বাস্থ্য, এবং জৈব বৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে ভারত সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার কিছু কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা বিশেষ করে ধান এবং তুলা চাষীদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ এই দুটি ফসল ভারতের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড। ধান ভারতের খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রধান উৎস, এবং তুলা হলো দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগদ ফসল। কীটনাশক নিষেধাজ্ঞা এই ফসলগুলির উৎপাদন, খরচ, এবং ফলনের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে চাষীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
Also Read | বপন মরশুমে বীজের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
২০২৫ সালে ভারত সরকার ক্লোরপিরিফস, ফরেট, এবং প্যারাকোয়াটের মতো কিছু বিষাক্ত কীটনাশকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বা তাদের ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে। এই কীটনাশকগুলো ধান এবং তুলা চাষে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, কারণ এগুলো কীটপতঙ্গ এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। তবে, এই রাসায়নিকগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, বিশেষ করে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। কেরালার মতো রাজ্যগুলো ইতিমধ্যে ২০১১ সালে ১৪টি বিষাক্ত কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছিল, যা ফসলের ফলনের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেনি বলে গবেষণায় দেখা গেছে। তবে, ২০২৫ সালের নতুন নিষেধাজ্ঞা জাতীয় স্তরে আরও বড় পরিসরে প্রয়োগ করা হচ্ছে, যা ধান এবং তুলা চাষীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
ধান ভারতের প্রধান খাদ্যশস্য, এবং এর উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্লোরপিরিফসের মতো কীটনাশক ধানের ক্ষেতে ইচিনোক্লোয়া এবং সাইপেরাস প্রজাতির আগাছা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। ২০২৫ সালে এই কীটনাশকের নিষেধাজ্ঞার ফলে চাষীদের বিকল্প সমাধানের দিকে যেতে হবে। বাজারে নতুন কীটনাশক, যেমন ডানুকা অ্যাগ্রিটেকের ‘দিনকার’ এবং ইনসেক্টিসাইডস ইন্ডিয়া লিমিটেডের ‘আলটায়ার’, ধান চাষীদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে, এই নতুন পণ্যগুলোর দাম বেশি এবং প্রয়োগ পদ্ধতি জটিল হওয়ায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জন্য এটি অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
Also Read | সবজি চাষের জন্য কিষাণ ক্রেডিট কার্ড লোন পাওয়ার সহজ ধাপ
এছাড়া, কীটনাশক নিষেধাজ্ঞার ফলে ফসলের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শ্রীলঙ্কার ২০২১ সালের কীটনাশক ও সার নিষেধাজ্ঞার উদাহরণে দেখা গেছে, ধানের উৎপাদন ২০% হ্রাস পেয়েছিল, যা খাদ্য সংকটের কারণ হয়েছিল। ভারতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে সরকার এবং কৃষি বিজ্ঞানীরা সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (IPM) এবং জৈব কীটনাশকের উপর জোর দিচ্ছে। তবে, এই পদ্ধতিগুলোর প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োগে সময় লাগবে, যা ক্ষুদ্র চাষীদের জন্য অসুবিধার কারণ হতে পারে।
তুলা চাষে কীটনাশকের ব্যবহার আরও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই ফসলটি পোকামাকড় এবং আগাছার আক্রমণের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতে তুলা উৎপাদনের ৪৫% কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা বিশ্বের গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। ফরেট এবং প্যারাকোয়াটের মতো কীটনাশক নিষিদ্ধ হওয়ায় তুলা চাষীদের উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে। নতুন কীটনাশক, যেমন ইউপিএল-এর ‘সেন্টুরিয়ন ইজেড’, তুলা ক্ষেতে আগাছা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হলেও এর উচ্চ মূল্য এবং প্রয়োগের জটিলতা চাষীদের জন্য চ্যালেঞ্জ।
Also Read |
এছাড়া, তুলা চাষে বিটি তুলার ব্যবহার বাড়ছে, যা কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা কমিয়েছে। তবে, বিটি তুলার প্রতি পোকামাকড়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে, যা নতুন কীটনাশকের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ২০২৫ সালে কীটনাশকের দাম ১০.৪% কমার পূর্বাভাস থাকলেও, নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে চাষীদের বিকল্প ব্যয় বাড়তে পারে।
কীটনাশক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমাতে সরকার এবং কৃষি সংস্থাগুলো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (IPM) এবং জৈব কীটনাশকের প্রচার বাড়ানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ফার্মোনটের মতো সংস্থাগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং স্যাটেলাইট-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে। এছাড়া, কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
Also Read | সজনে ডাটা দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ওজন কমানোর সহজ উপায়
তবে, এই রূপান্তরের জন্য সময় এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন। ক্ষুদ্র চাষীদের জন্য সরকারি ভর্তুকি এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আরও জোরদার করা দরকার। কেরালার উদাহরণ অনুসরণ করে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলো যদি কীটনাশক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বিকল্প সমাধানের উপর জোর দেয়, তবে ফলনের উপর প্রভাব কমানো সম্ভব।
২০২৫ সালের কীটনাশক নিষেধাজ্ঞা ধান এবং তুলা চাষীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা দুটোই নিয়ে এসেছে। যদিও উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে এবং ফলনের উপর ঝুঁকি থাকতে পারে, তবে সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এই প্রভাব কমাতে পারে। সরকার, কৃষি বিজ্ঞানী, এবং চাষীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভারতের কৃষি খাত এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবেলা করে টেকসই উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।