বর্ধমানে পোকার আক্রমণ, ধান উৎপাদনের উপর গভীর প্রভাব

পশ্চিমবঙ্গের ধানের গোলা (Rice Production) হিসেবে খ্যাত বর্ধমান (Bardhaman) জেলায় ২০২৫ সালে পোকার আক্রমণ ধান উৎপাদনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার, ধানের…

Pest Outbreak in Bardhaman Threatens Rice Production

পশ্চিমবঙ্গের ধানের গোলা (Rice Production) হিসেবে খ্যাত বর্ধমান (Bardhaman) জেলায় ২০২৫ সালে পোকার আক্রমণ ধান উৎপাদনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার, ধানের হিসপা, এবং লিফ ফোল্ডারের মতো পোকার আক্রমণের ফলে কৃষকরা উল্লেখযোগ্য ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এই ঘটনা জেলার কৃষি অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলছে, এবং স্থানীয় কৃষকরা তাদের জীবিকার উপর এই সংকটের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

পোকার আক্রমণের প্রকৃতি ও প্রভাব
বর্ধমানে ধানের ফসলের উপর পোকার আক্রমণ একটি পুরনো সমস্যা হলেও, ২০২৫ সালে এর তীব্রতা অভূতপূর্ব। ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার (নিলাপারভাটা লুগেন্স) এবং হিসপা বিটল (ডিক্লাডিসপা আরমিগেরা) ধান গাছের কাণ্ড, পাতা এবং শিকড়ের ক্ষতি করছে, যা ফলন কমিয়ে দিচ্ছে। আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ঋতু পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতার কারণে ধান গাছের উপর পোকার আক্রমণ বেড়েছিল, এবং কীটনাশক ব্যবহার করেও কৃষকরা তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ২০২৫ সালে এই সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে, বিশেষ করে বোরো এবং আমন মৌসুমে। ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার ধান গাছের কাণ্ড থেকে রস শুষে নেয় এবং রাইস র‍্যাগড স্টান্ট ভাইরাস (আরআরএসভি) এবং রাইস গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাস (আরজিএসভি) সংক্রমণ করে, যা ফলনের ব্যাপক ক্ষতি করে।

   

ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইআরআরআই)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রাউন প্ল্যান্ট হপারের আক্রমণে বাংলাদেশে ২০০৫-২০০৬ সালে ৮২৮,০০০ টন ধানের ক্ষতি হয়েছিল, যার মূল্য ছিল ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্ধমানে এই বছরের হিসেবে, কিছু এলাকায় ফলন ৪৪% পর্যন্ত কমে গেছে। এই পোকার আক্রমণ শুধু ফলনই কমায় না, বরং কৃষকদের উৎপাদন খরচও বাড়িয়ে দেয়, কারণ তারা কীটনাশকের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তন এই পোকার আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলছে। উচ্চ তাপমাত্রা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত পোকার প্রজনন ও বিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। ইউএন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও)-এর মতে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফেস পোকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্ধমানে ২০২৫ সালে দীর্ঘ শুষ্ক সময় এবং তারপর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, হিসপা বিটল উচ্চ আর্দ্রতা এবং ছায়াযুক্ত পরিবেশে দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

কৃষকদের চ্যালেজ
বর্ধমানের কৃষকরা পোকার আক্রমণ মোকাবিলায় কীটনাশকের উপর নির্ভর করছেন, কিন্তু এর ফলাফল সন্তোষজনক নয়। আনন্দবাজারের ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কীটনাশক প্রয়োগ সত্ত্বেও ধান গাছ খড়ের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে। কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, যেমন উপকারী পোকার ধ্বংস, পোকার প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং খাদ্য শৃঙ্খলে বিষাক্ত পদার্থের জমা। এছাড়া, কীটনাশকের খরচ কৃষকদের অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (আইপিএম)
বিশেষজ্ঞরা পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (আইপিএম) পদ্ধতির পরামর্শ দিচ্ছেন। এই পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব কৌশল, যেমন প্রাকৃতিক শত্রু পোকার সংরক্ষণ, প্রতিরোধী ধানের জাত ব্যবহার, এবং কীটনাশকের সীমিত ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত। আইআরআরআই-এর মতে, ধান ক্ষেতের চারপাশে ফুলের গাছ লাগানো প্রাকৃতিক শত্রু পোকার সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া, ফসলের প্রথম ৪০ দিন কীটনাশক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এই সময়ে ধান গাছ সাধারণত প্রাথমিক ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারে।

Advertisements

এক গবেষণায় দেখা গেছে, আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে ফলন তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকে। এই পদ্ধতিতে পার্চিং, সুইপিং, এবং প্রয়োজনভিত্তিক কীটনাশক প্রয়োগের মতো কৌশল অন্তর্ভুক্ত। এটি পোকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং পরিবেশের ক্ষতি কমায়।

সরকারি ও কৃষকদের উদ্যোগ
বর্ধমানের স্থানীয় কৃষকরা সরকারি সহায়তার অভাবে হতাশ। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিরোধী ধানের জাত এবং আইপিএম পদ্ধতির প্রচার করছে, কিন্তু কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। সরকারের উচিত কৃষকদের প্রশিক্ষণ, প্রাকৃতিক শত্রু পোকার সংরক্ষণ, এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
২০২৫ সালে বর্ধমানে পোকার আক্রমণ মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ড্রোন-ভিত্তিক ইউএভি ইমেজিং এবং গভীর শিক্ষার (ডিপ লার্নিং) কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি ধান ক্ষেতের পোকা এবং রোগের দ্রুত সনাক্তকরণে সাহায্য করে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
বর্ধমানের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। পোকার আক্রমণের ফলে ফলন হ্রাস পাওয়ায় কৃষকদের জীবিকার উপর প্রভাব পড়ছে। এই সংকট কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করছে এবং স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বাড়তে পারে। সরকারি হস্তক্ষেপ এবং কৃষকদের সহায়তা ছাড়া এই সমস্যা আরও তীব্র হতে পারে।

বর্ধমানে পোকার আক্রমণ ধান উৎপাদনের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রতিরোধী জাত, এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। তবে, কৃষকদের সচেতনতা বাড়ানো এবং সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে স্থানীয় সম্প্রদায় এবং সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।