দক্ষিণবঙ্গের কৃষকরা তাদের উদ্ভাবনী মিশ্র চাষ (Triple Crop Farming) পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি খাতে এক নতুন দিশা দেখাচ্ছেন। পেঁপে, টমেটো এবং লঙ্কার সমন্বিত চাষ, যা ইন্টারক্রপিং বা মিশ্র চাষ নামে পরিচিত, দক্ষিণবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক এবং টেকসই মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই পদ্ধতি শুধুমাত্র জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে না, বরং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা দক্ষিণবঙ্গে পেঁপে, টমেটো এবং লঙ্কার মিশ্র চাষের সাফল্য, এর সুবিধা এবং বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
মিশ্র চাষের সুবিধা
মিশ্র চাষ হল এমন একটি কৃষি পদ্ধতি, যেখানে একই জমিতে একাধিক ফসল একসঙ্গে চাষ করা হয়। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি, যেমন হুগলি, হাওড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এই পদ্ধতির জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত। পেঁপে, টমেটো এবং লঙ্কার সমন্বয়ে চাষের কিছু মূল সুবিধা হল:
জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার: পেঁপে গাছ লম্বা হওয়ায় এর নীচে ছায়ায় টমেটো এবং লঙ্কার মতো ছোট ফসল চাষ করা যায়। এটি জমির স্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে।
বৈচিত্র্যময় আয়: তিনটি ফসলই বাজারে উচ্চ চাহিদা সম্পন্ন। পেঁপে এবং টমেটোর দাম সারা বছর স্থিতিশীল থাকে, এবং লঙ্কা উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়, যা কৃষকদের জন্য নিয়মিত আয় নিশ্চিত করে।
মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ: পেঁপে গাছের গভীর শিকড এবং টমেটো ও লঙ্কার অগভীর শিকড় মাটির পুষ্টি ভিন্নভ(Core)ভাবে ব্যবহার করে, যা মাটির ক্ষয় রোধ করে।
কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ: এই ফসলগুলির বিভিন্ন কীটপতঙ্গের প্রতি আকর্ষণ ভিন্ন হওয়ায় কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যায়।

দকিণবঙ্গে কেন এই মডেল জনপ্রিয়
দক্ষিণবঙ্গের উর্বর মাটি, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণ জলবায়ু এই তিনটি ফসলের জন্য আদর্শ। পেঁপে গাছ দ্রুত বাড়ে এবং দুই থেকে তিন বছরে ফল দেয়, যা কৃষকদের বাজারে প্রবেশের সময় দেয়। টমেটো এবং লঙ্কা দ্রুত ফলন দেয়, যা পেঁপের সঙ্গে একত্রে চাষ করলে কৃষকদের একাধিক ফসলের আয় নিশ্চিত হয়। স্থানীয় কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (কেভিকে) এবং কৃষি দপ্তরের সহায়তায় কৃষকরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করছেন।
বাস্তবায়নের কৌশল
১. ফসল নির্বাচন: পেঁপে প্রধান ফসল হিসেবে রাখা হয়, যার সারা বছর ফলন থাকে। টমেটো এবং লঙ্কা সেকেন্ডারি ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। টমেটোর জন্য ৬০ সেন্টিমিটার দূরত্বে চাষ করা হয়, এবং লঙ্কা ৩০-৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাগানো হয়।
২. মাটির প্রস্তুতি: মাটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। পেঁপের জন্য মাটির পিএইচ ৬.০-৭.০ এবং টমেটো ও লঙ্কার জন্য ৫.৫-৬.৫ হওয়া উচিত।
৩. সেচ ব্যবস্থা: ড্রিপ ইরিগেশন বা ফ্লাড ইরিগেশন ব্যবহার করা হয়। পেঁপের জন্য সপ্তাহে একবার এবং টমেটো ও লঙ্কার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী জল দেওয়া হয়।
৪. কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ: জৈব কীটনাশক এবং ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। পেঁপের জন্য নিম তেল এবং টমেটো ও লঙ্কার জন্য বোর্দো মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. ফসল কাটার সময়: পেঁপে ৬-৮ মাসে, টমেটো ২-৩ মাসে এবং লঙ্কা ৩-৪ মাসে কাটা যায়।
সাফল্যের গল্প
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষক রমেশ মণ্ডল এই পদ্ধতি গ্রহণ করে বছরে প্রায় ২ লক্ষ টাকার বেশি আয় করেছেন। তিনি বলেন, “পেঁপে আমার প্রধান ফসল, এবং এর পাশাপাশি টমেটো এবং লঙ্কা চাষ করে আমি আমার আয় দ্বিগুণ করেছি। বাজারে লঙ্কার দাম বেশি থাকায় আমার লাভ বেড়েছে।” তিনি জৈব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৫০% কমিয়েছেন, যা পরিবেশের জন্যও উপকারী।
এছাড়াও, হুগলির কৃষক সংগঠন (এফপিও) এই মডেলের মাধ্যমে তাদের সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ প্রদান করছে। তারা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি কলকাতার বড় বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করে উচ্চ মূল্যে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
মিশ্র চাষে কিছু চ্যালেঞ্জ rয়েছে, যেমন কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারজাতকরণ। তবে, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (কেভিকে) এবং রাজ্য কৃষি দপ্তর প্রশিক্ষণ, ভর্তুকিযুক্ত সার এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা করছে। এছাড়াও, জৈব সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার বাড়িয়ে এই সমস্যাগুলি মোকাবেলা করা যায়।
বাংলার কৃষকদের জন্য তাৎপর্য
দক্ষিণবঙ্গের কৃষকদের জন্য এই মিশ্র চাষ পদ্ধতি একটি গেম-চেঞ্জার। এটি শুধুমাত্র তাদের আয় বাড়ায় না, বরং জমির উৎপাদনশীলতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখে। রাজ্য সরকারের জৈব কৃষি ভর্তুকি প্রকল্প এবং কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের সহায়তায় কৃষকরা এই পদ্ধতি আরও সহজে গ্রহণ করতে পারছেন।
পেঁপে, টমেটো এবং লঙ্কার মিশ্র চাষ দক্ষিণবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি টেকসই এবং লাভজনক মডেল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এই পদ্ধতি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, বৈচিত্র্যময় আয় এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক। কৃষকদের প্রশিক্ষণ, জৈব সার এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে এই মডেল আরও জনপ্রিয় হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গের কৃষকরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে তাদের জীবিকা উন্নত করতে পারেন এবং কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারেন।