নিজস্ব সংবাদদাতা | কলকাতা, ৭ অক্টোবর ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের আয় বাড়াতে ও কৃষিক্ষেত্রে স্থায়িত্ব আনতে রাজ্য সরকার চালু করতে চলেছে একটি নতুন ফসল বৈচিত্র্য প্রকল্প (Crop Diversification Scheme)। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী মৌসুম থেকেই এই প্রকল্প কার্যকর হবে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রাজ্যের ১২টি জেলায় এটি চালু করা হবে।
এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো ধান-কেন্দ্রিক কৃষি থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে ডাল, তেলবীজ, শাকসবজি ও ফলের মতো বিকল্প ফসলের চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা। এর ফলে কৃষকদের আয় বাড়ার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও আরও শক্তিশালী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কেন প্রয়োজন ফসল বৈচিত্র্যকরণ?
রাজ্যের প্রায় ৬৫ শতাংশ জমি এখনো ধান চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে এক ফসলের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে কৃষকরা বারবার লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছেন। কখনো অতিবৃষ্টি, কখনো খরা বা বাজারমূল্যের ওঠাপড়া কৃষকদের আয়কে অনিশ্চিত করে তুলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফসল বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে কৃষকরা ঝুঁকি কমাতে পারবেন। যেমন, ডাল বা তেলবীজ চাষে তুলনামূলক কম খরচ হয় এবং বাজারে এর চাহিদা বেশি। একইসঙ্গে শাকসবজি ও ফল চাষে কৃষকের নগদ আয় দ্রুত আসে, যা তাঁদের আর্থিক স্থিতি মজবুত করতে সাহায্য করবে।
সরকারের পরিকল্পনা
কৃষি দপ্তরের এক আধিকারিক জানান, “প্রথম ধাপে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, হুগলি, বীরভূম, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় এই প্রকল্প চালু হবে।”
প্রকল্পের অধীনে কৃষকদের বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে বীজ, সার ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হবে। পাশাপাশি, কৃষকদের জন্য ফার্মার ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু করা হবে, যেখানে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও জৈব চাষের কৌশল শেখানো হবে।
কৃষকদের প্রতিক্রিয়া
পূর্ব বর্ধমানের এক কৃষক বলেন, “প্রতিবার ধান চাষ করে লাভ হয় না। যদি সরকার ডাল বা শাকসবজি চাষে সাহায্য করে, তাহলে আমাদের আয় বাড়বে।”
অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদের এক মহিলা কৃষক জানান, “ফসল বদল করলে একই জমিতে একাধিকবার আয় করা সম্ভব। বিশেষ করে সবজি ও ফল চাষে মহিলারা বেশি লাভবান হতে পারবেন।”
বিশেষজ্ঞদের মত
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, এই উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রোটিন-সমৃদ্ধ ডাল ও তেলবীজের চাহিদা বাড়ছে। তাই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কৃষকদের উৎপাদন বৈচিত্র্য আনতে পারলে তাঁরা বেশি লাভবান হবেন।
কর্মসংস্থানের সুযোগ
প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। শাকসবজি ও ফল চাষের সঙ্গে সঙ্গে কোল্ড স্টোরেজ, প্রসেসিং ইউনিট ও মার্কেট লিঙ্কেজ তৈরি হলে বহু মানুষ কাজের সুযোগ পাবেন।
ভবিষ্যৎ লক্ষ্য
রাজ্য সরকার জানিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ ধানচাষের জমি বিকল্প ফসলের আওতায় আনা হবে। একইসঙ্গে কৃষকরা যেন ন্যায্য দামে তাঁদের ফসল বিক্রি করতে পারেন, তার জন্য ই-ন্যাশনাল এগ্রি মার্কেট (e-NAM)-এর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ তৈরি করা হবে।
এই নতুন ফসল বৈচিত্র্য প্রকল্প শুধু কৃষকদের আয় বাড়াবে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখবে। রাজ্য সরকারের আশা, কৃষকের হাসিই হবে এই প্রকল্পের আসল সাফল্যের মাপকাঠি।