ভারতীয় কৃষি বাজারে সংস্কারের (Agri Market Reforms) বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষি আইন (Farmers’ Produce Trade and Commerce Act, Farmers’ Empowerment and Protection Agreement on Price Assurance and Farm Services Act, এবং Essential Commodities Amendment Act) প্রবর্তনের পর থেকে এই বিষয়টি আরও জটিল এবং বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। যদিও এই আইনগুলো ২০২১ সালে প্রত্যাহার করা হয়েছিল, কৃষি বাজার সংস্কার, বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি (APMC) সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৬ সালের আগে নতুন কৃষি বাজার সংস্কার আসার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা চলছে। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব যে এই সম্ভাব্য সংস্কারগুলো কী হতে পারে এবং ভারতীয় কৃষকদের এ বিষয়ে কী জানা উচিত।
APMC সংস্কার: প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান অবস্থা
কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি (APMC) হল এমন একটি ব্যবস্থা যা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির জন্য নিয়ন্ত্রিত বাজার (মান্ডি) প্রদান করে। এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের মধ্যস্থতাকারীদের শোষণ থেকে রক্ষা করা এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে APMC ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- মধ্যস্থতাকারীদের আধিপত্য: APMC মান্ডিতে কমিশন এজেন্ট (আড়তিয়া) এবং ব্যবসায়ীদের প্রভাবের কারণে কৃষকরা প্রায়ই ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
- বাজারের সীমাবদ্ধতা: কৃষকরা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট APMC মান্ডিতে তাদের ফসল বিক্রি করতে পারেন, যা প্রায়ই তাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।
- উচ্চ মান্ডি ফি: APMC মান্ডিতে বিভিন্ন ফি এবং সেসের কারণে কৃষকদের লাভ কমে যায়।
- অপর্যাপ্ত অবকাঠামো: অনেক APMC মান্ডিতে পর্যাপ্ত স্টোরেজ, গ্রেডিং এবং টেস্টিং সুবিধার অভাব রয়েছে।
২০০৩ সালে মডেল APMC আইন এবং ২০১৭ সালে মডেল APLM (Agricultural Produce and Livestock Marketing) আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোকে বাজার সংস্কারের জন্য উৎসাহিত করেছিল। তবে, এই সংস্কারগুলো রাজ্যগুলোর মধ্যে অসমভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিহার ২০০৬ সালে APMC আইন বাতিল করলেও, এর ফলে কৃষকরা প্রত্যাশিত সুবিধা পায়নি, বরং অবকাঠামোর অভাব এবং উচ্চ লেনদেন খরচের সমস্যায় পড়েছে।
সম্ভাব্য নতুন সংস্কার: কী আসতে পারে?
২০২০ সালের কৃষি আইনগুলো প্রত্যাহারের পর, কৃষি সংস্কার নিয়ে আলোচনা থামেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৬ সালের আগে নতুন কৃষি বাজার সংস্কারের সম্ভাবনা রয়েছে, যা নিম্নলিখিত দিকগুলোর উপর কেন্দ্রীভূত হতে পারে:
APMC মান্ডির আধুনিকীকরণ:
APMC ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো দূর করতে সরকার এই বাজারগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে জোর দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক স্টোরেজ সুবিধা, গ্রেডিং এবং কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাব স্থাপন। ইলেকট্রনিক ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট (e-NAM) প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণ এবং উন্নতি এই সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। e-NAM বর্তমানে ২১টি রাজ্য এবং ৩টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ১,০০০টি বাজারকে একীভূত করেছে, কিন্তু এর কার্যকারিতা এখনও সীমিত।
বাধাহীন আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য:
নতুন সংস্কারে কৃষকদের APMC মান্ডির বাইরে, যেমন ফার্ম গেট, কোল্ড স্টোরেজ বা অন্যান্য বিকল্প চ্যানেলের মাধ্যমে ফসল বিক্রির স্বাধীনতা দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হতে পারে। এটি আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের বাধা দূর করবে এবং কৃষকদের আরও ভালো দাম পেতে সাহায্য করবে।
চুক্তিভিত্তিক চাষ (Contract Farming):
কৃষকদের বড় কৃষি-ব্যবসায়ী সংস্থা বা খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে পূর্ব-নির্ধারিত দামে চুক্তি করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এটি কৃষকদের বাজার ঝুঁকি কমাতে এবং ফসল বপনের সময়ই নিশ্চিত দাম পাওয়ার সুযোগ দেবে। তবে, এই ব্যবস্থায় কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য শক্তিশালী বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা প্রয়োজন।
ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP) নিয়ে স্পষ্টতা:
২০২০ সালের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রধান অভিযোগ ছিল MSP ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। যদিও সরকার জানিয়েছিল যে MSP অব্যাহত থাকবে, কৃষকরা একটি আইনি গ্যারান্টি দাবি করেছিল। ভবিষ্যৎ সংস্কারে MSP-এর জন্য একটি সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো প্রবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা সমগ্র ভারতের সকল ফসলের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
বেসরকারি বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন:
কৃষি সেক্টরে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকার কোল্ড স্টোরেজ, গুদাম এবং সাপ্লাই চেইন আধুনিকীকরণে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারে। এটি ফসলের অপচয় কমাবে এবং কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদী স্টোরেজের সুবিধা দেবে।
কৃষকদের জন্য কী জানা জরুরি?
২০২৬ সালের আগে কৃষকদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত:
নতুন সংস্কারের সম্ভাব্য প্রভাব:
নতুন সংস্কারগুলো কৃষকদের বাজারে আরও স্বাধীনতা দিতে পারে, তবে এটি বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার চ্যালেঞ্জও তৈরি করতে পারে। কৃষকদের এই প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
e-NAM এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম:
e-NAM-এর মাধ্যমে অনলাইন ট্রেডিংয়ের সুবিধা গ্রহণ করতে কৃষকদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। এর জন্য ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বর্তমানে e-NAM-এ ১.৭৬ মিলিয়ন কৃষক নিবন্ধিত, এবং এটির মাধ্যমে ২.৮৮ লক্ষ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে।
MSP এবং আইনি গ্যারান্টি:
কৃষকদের MSP-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের উপর নজর রাখতে হবে। যদি MSP-এর জন্য আইনি গ্যারান্টি দেওয়া হয়, তবে এটি কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা বাড়াতে পারে।
কৃষক উৎপাদক সংগঠন (FPO):
কৃষকদের FPO-তে যোগদানের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে বাজারে দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো উচিত। এটি তাদের বড় ক্রেতাদের সঙ্গে সমানভাবে প্রতিযোগিতা করতে সাহায্য করবে।
অবকাঠামো এবং বিনিয়োগ:
সরকারের প্রস্তাবিত ১ লক্ষ কোটি টাকার কৃষি অবকাঠামো তহবিল কৃষকদের জন্য স্টোরেজ এবং পরিবহন সুবিধা উন্নত করতে পারে। কৃষকদের এই তহবিলের সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ
নতুন সংস্কারগুলোর মাধ্যমে কৃষকরা বাজারে আরও স্বাধীনতা এবং ভালো দাম পাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। তবে, এই সংস্কারগুলোর সফলতা নির্ভর করবে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয় এবং বাস্তবায়নের উপর। ২০২০ সালের কৃষি আইন নিয়ে বিতর্ক থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারকে কৃষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং তাদের আস্থা অর্জন করে এগোতে হবে।
কৃষকদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ যে তারা নতুন সংস্কারের বিষয়ে সচেতন থাকেন এবং এর সুবিধা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হন। সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং অবকাঠামো সুবিধা প্রদানের উপর জোর দেওয়া উচিত। ২০২৬ সালের আগে এই সংস্কারগুলো কৃষি খাতে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে, তবে এর সফলতা নির্ভর করবে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর উপর।