বর্ষা এলেই জলমগ্ন হয়ে পড়ত হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর— এই পাঁচ জেলার বিস্তীর্ণ অংশ। বৃষ্টি একটু বেশি হলেই দামোদর নদীর জল বেড়ে উপচে পড়ত। বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হত চাষের জমি, ডুবে যেত গ্রামের পর গ্রাম। বছরের পর বছর ধরে এই চিত্র ছিল একই রকম। অভিযোগ ছিল, বাঁধের উচ্চতা কম, অনেক জায়গায় ফাটল ছিল, এবং নদীর খালগুলি নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন এসেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) বিশেষ উদ্যোগে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাহায্যে রাজ্য সরকার ‘দামোদর রিভার ইমপ্রুভমেন্ট স্কিম’-এর আওতায় নদীর বাঁধ ও সংলগ্ন খালগুলির সংস্কার করে। এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে তিন হাজার কোটিরও বেশি টাকা। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল বর্ষার জল দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা করা, নদী বাঁধ মজবুত করা, এবং প্লাবনপ্রবণ এলাকার জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা। দীর্ঘ পরিকল্পনা ও গবেষণার পর শুরু হয় কাজ। প্রথম পর্যায়ে পূর্ব দামোদরের বিভিন্ন বাঁধ মেরামত করা হয়। হাওড়ার আমতা ২ নম্বর ব্লক, উদয়নারায়নপুর, হুগলির খানাকুল, বর্ধমানের কাটোয়া এবং মেদিনীপুরের ঘাটাল—এই সমস্ত এলাকায় প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, পূর্ব দামোদরের গতিপথে অনেক জায়গায় বাঁধের উচ্চতা ৬-৭ ফুটের বেশি ছিল না, যেখানে বর্ষার সময় দামোদরের জলস্তর পৌঁছে যায় ১০-১২ ফুটে। নতুন প্রকল্পে এই বাঁধগুলির উচ্চতা বাড়িয়ে ১৪-১৫ ফুট পর্যন্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক বাঁধে কংক্রিটের গার্ডওয়াল তৈরি হয়েছে যাতে জলের ধাক্কায় বাঁধ না ভেঙে যায়। পাশাপাশি, যেসব খাল দিয়ে দামোদরের অতিরিক্ত জল বিভিন্ন নদীতে প্রবাহিত হত, সেগুলিরও খনন ও প্রশস্তকরণ করা হয়েছে। বহু খাল পুনরুজ্জীবিত হয়েছে দীর্ঘ বছর পরে।
এই প্রকল্পের বাস্তব সুফল এবার মিলছে। চলতি বর্ষায় বহু জেলায় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাওড়ার আমতা ২ নম্বর ব্লক ও উদয়নারায়নপুরের অধিকাংশ এলাকায় এখনও জল জমেনি। আগের বছরের তুলনায় এ বছর চাষের জমিতে জল দাঁড়ায়নি বললেই চলে। কৃষকেরা জানাচ্ছেন, এই সময়েই আগের বছর ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে যেত। অথচ এ বছর বর্ষা শুরুর সঙ্গেই তাঁরা নির্বিঘ্নে রোয়া শুরু করেছেন। জল নেমে যাচ্ছে দ্রুত, যা আগের বছর ছিল কল্পনাতীত।
উদয়নারায়নপুরের বাসিন্দা কৃষক প্রভাত পাত্র বলেন, “আগে বর্ষা মানেই আতঙ্ক। দামোদর উপচে পড়লেই সব শেষ। এখন সেই সমস্যা অনেকটাই নেই। এবার জল জমছে না, জমলেও ১-২ দিনের মধ্যে নেমে যাচ্ছে।” একই অভিমত আমতার আরও অনেক কৃষকের। তাঁরা বলছেন, এমন পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে গ্রামে চাষের পাশাপাশি রাস্তাঘাটও সুরক্ষিত থাকছে।
হাওড়া জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক জানান, “মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই এত বড় প্রকল্প সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের তদারকিতে সমস্ত কাজ হয়েছে স্বচ্ছভাবে। আগামী দিনে আরও কিছু খাল সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নদী ও খাল সংস্কারের এই পরিকল্পনা আগামী দশ বছরের জন্য রাজ্যের কৃষি ও জলনিষ্কাশন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। আর এই প্রকল্পের সাফল্যই প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা এবং সদিচ্ছা থাকলে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব।