সম্প্রতি ভারতীয় চিনি ও বায়ো-এনার্জি নির্মাতা সমিতি (ISMA) বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে জ্বালানি মিশ্রণের জন্য ইথানল আমদানির সম্ভাব্য বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চিঠিতে সমিতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনার প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় কৃষক এবং স্বনির্ভর এথানল অর্থনীতির জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
ISMA চিঠিতে উল্লেখ করেছে, দেশের এথানল ব্লেন্ডিং প্রোগ্রাম (EBP) শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রচারের মাধ্যম নয়, এটি দেশের লক্ষ লক্ষ আখচাষীর জীবনমান উন্নত করতে এবং তাদের আয় বাড়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২০১৮ সালের জাতীয় বায়োফুয়েল নীতি এবং একই বছরের ২১ আগস্ট DGFT (Directorate General of Foreign Trade) এর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জ্বালানি মিশ্রণের জন্য ইথানল আমদানিকে ‘নিয়ন্ত্রিত’ (restricted) শ্রেণিতে রাখার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা দেশের মধ্যে শক্তিশালী এবং স্বনির্ভর এথানল শিল্প গড়ে তোলার ভিত্তি তৈরি করেছে।
সরকারি সুদ সহায়তা (interest subvention) প্রকল্প, নীতি সহায়তা, এবং নিয়ন্ত্রক সুবিধার মাধ্যমে দেশজ ইথানল উৎপাদন সক্ষমতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালের পর থেকে ভারতীয় এথানল উৎপাদন ক্ষমতা ১৪০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই খাতে ৪০,০০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। বর্তমানে ভারতের এথানল মিশ্রণের হার ১৮.৮৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং দেশ ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের আগেই ২০ শতাংশ মিশ্রণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে রয়েছে।
ISMA আরও জানিয়েছে, এই সাফল্যের ফলে দেশের চিনি শিল্পের স্থিতিশীলতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি কৃষকরা সময়মতো ন্যায্য দামে তাদের ফসলের মূল্য পেয়েছেন। ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা ও আমদানি নির্ভরতা কমানোতেও এটি বড় অবদান রেখেছে।
চিঠিতে সমিতি সতর্ক করে জানিয়েছে, যদি জ্বালানি মিশ্রণের জন্য ইথানল আমদানি অনুমোদন দেওয়া হয়, তবে এর ফলে দেশীয় উৎপাদকদের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। আখচাষীদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (FRP) এবং এথানলের বাজারমূল্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমদানি করা সস্তা ইথানলের প্রভাবে দেশীয় বাজারে দরপতন ঘটলে কৃষকদের সময়মতো অর্থপ্রদান ব্যাহত হতে পারে এবং তাদের আয় হ্রাস পেতে পারে।
এছাড়া, দেশে গড়ে ওঠা বিশাল ইথানল উৎপাদন অবকাঠামো, যেটিতে বহু মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত, তার ব্যবহার ব্যাহত হবে। দেশীয় বিনিয়োগ কমে যাবে, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কমবে, এবং সবমিলিয়ে দেশের সবুজ জ্বালানি ও শক্তি স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে একটি বড় ধাক্কা আসতে পারে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের পর থেকে যে স্বনির্ভর ইথানল শিল্পের ভিত্তি গড়ে উঠেছে, তা আগামীতে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য কৃষক, বিনিয়োগকারী এবং শিল্প সংশ্লিষ্টদের আস্থা অত্যন্ত জরুরি। নীতি স্থিতিশীল না থাকলে নতুন বিনিয়োগ এবং সম্প্রসারণ প্রকল্পগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
ISMA তাদের চিঠিতে স্পষ্টভাবে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছে যে, জ্বালানি মিশ্রণের জন্য ইথানল আমদানির ওপর বর্তমানে যে বিধিনিষেধ রয়েছে, তা অক্ষুণ্ণ রাখা হোক। সরকারের উচিত দেশীয় শিল্পের বিকাশ, কৃষকের স্বার্থ, এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
চিঠির শেষাংশে ISMA আশাপ্রকাশ করেছে যে, কেন্দ্র সরকার জাতীয় স্বার্থ, কৃষকের কল্যাণ এবং ভারতের বৈশ্বিক সবুজ জ্বালানির নেতৃত্ব বজায় রাখার বিষয়টি সর্বদা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে কৃষকরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা রক্ষা করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়াও, ভারতের আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন সফল করতে দেশের নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে আরও মজবুত করার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
ISMA’র এই চিঠি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। এই আলোচনায় ইথানল আমদানি সহজ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকায় দেশীয় শিল্পে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেক শিল্প বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, দেশীয় উৎপাদকদের সুরক্ষার জন্য সরকারকে স্পষ্ট ও স্থির অবস্থান নিতে হবে এবং নীতি হঠাৎ পরিবর্তন থেকে বিরত থাকতে হবে।
চিঠিতে ISMA স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, সরকার যদি দেশে উৎপাদিত এথানলের জন্য একটি সুরক্ষিত বাজার নিশ্চিত করে, তাহলে কৃষকদের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং দেশের শক্তি নিরাপত্তা উভয়ই রক্ষা করা সম্ভব। একইসঙ্গে এটি দেশের কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হবে।
ISMA’র এই আবেদন যে দেশের কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করবে, তা বলাই বাহুল্য। ইথানল নীতি ও আমদানির বিধিনিষেধ নিয়ে সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেশের জ্বালানি এবং কৃষি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।