প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা কি সত্যিই কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গে? একটি পর্যালোচনা

প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (PMFBY), ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দ্বারা চালু করা, ভারতের কৃষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী ফসল বিমা প্রকল্প। এই প্রকল্পটি…

PMFBY, Crop Insurance, Farmer Protection, West Bengal

প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (PMFBY), ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দ্বারা চালু করা, ভারতের কৃষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী ফসল বিমা প্রকল্প। এই প্রকল্পটি পূর্ববর্তী জাতীয় কৃষি বিমা যোজনা (NAIS) এবং পরিবর্তিত জাতীয় কৃষি বিমা যোজনা (MNAIS)-এর সেরা বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে এবং তাদের ত্রুটিগুলি সংশোধন করে ‘এক জাতি-এক প্রকল্প’ থিমের আওতায় প্রণীত হয়েছে। এর লক্ষ্য হল কৃষকদের উপর প্রিমিয়ামের বোঝা কমানো এবং ফসলের ক্ষতির ক্ষেত্রে দ্রুত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এই প্রকল্পটি কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, প্রশ্ন উঠছে—পিএমএফবিওয়াই কি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য কার্যকর? এই নিবন্ধে আমরা প্রকল্পটির প্রভাব এবং এর সাফল্য ও চ্যালেঞ্জগুলি বিশ্লেষণ করব।

পিএমএফবিওয়াই-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য
প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা কৃষকদের ফসলের ক্ষতির বিরুদ্ধে ব্যাপক সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে। এর কিছু মূল বৈশিষ্ট্য হল:

   
  • কম প্রিমিয়াম: খরিফ ফসলের জন্য কৃষকদের ২% এবং রবি ফসলের জন্য ১.৫% প্রিমিয়াম দিতে হয়, বাকি অংশ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ভর্তুকি দেয়। বাণিজ্যিক ও উদ্যান ফসলের জন্য প্রিমিয়াম ৫%।
  • ব্যাপক কভারেজ: প্রকল্পটি প্রাক-বপন থেকে ফসল কাটার পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত প্রাকৃতিক ঝুঁকি যেমন বন্যা, খরা, ঝড়, কীটপতঙ্গ এবং রোগের কারণে ফসলের ক্ষতি কভার করে।
  • দ্রুত ক্ষতিপূরণ: ক্ষতিপূরণ দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রযুক্তি-নির্ভর মূল্যায়ন এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার উপর জোর দেওয়া হয়।
  • স্টেকহোল্ডার ইন্টিগ্রেশন: কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, ব্যাংক, সাধারণ সেবা কেন্দ্র (CSCs) এবং বীমা কোম্পানিগুলি একটি একক প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়।

২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গে পিএমএফবিওয়াই-এর অধীনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কৃষক তাদের ফসলের জন্য বিমা করেছেন। ইন্ডিয়াস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত রাজ্যে বিভিন্ন মৌসুমে কৃষকদের আবেদন, প্রিমিয়াম এবং ক্ষতিপূরণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে পিএমএফবিওয়াই-এর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে পিএমএফবিওয়াই-এর প্রভাব মিশ্র। প্রকল্পটি কৃষকদের জন্য কিছু সুবিধা নিয়ে এসেছে, তবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:

কৃষকদের সুবিধা:

Advertisements
  • আর্থিক সুরক্ষা: ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা প্রায় ৯৫,০০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, যা তাদের প্রিমিয়ামের (১৭,০০০ কোটি টাকা) তুলনায় অনেক বেশি। এটি কৃষকদের ফসলের ক্ষতির পর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রদান করেছে।
  • ফসলের বৈচিত্র্য: ধান, পাট, এবং সবজির মতো ফসলের জন্য বিমা কভারেজ পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের ফসলের বৈচিত্র্য বজায় রাখতে উৎসাহিত করেছে।
  • প্রযুক্তি ব্যবহার: ক্ষতির মূল্যায়নের জন্য ড্রোন এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করেছে।
    চ্যালেঞ্জগুলি:
  • দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব: ২০২১ সালে লোকসভায় পেশ করা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষতিপূরণ দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব পিএমএফবিওয়াই-এর মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করছে। পশ্চিমবঙ্গে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত বকেয়া ক্ষতিপূরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ছিল।
  • সচেতনতার অভাব: অনেক কৃষক, বিশেষ করে ছোট এবং প্রান্তিক কৃষক, প্রকল্পের বিশদ বিবরণ এবং আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন। এটি গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা প্রচারের অভাবের কারণে।
  • উচ্চ প্রিমিয়াম বোঝা: যদিও কৃষকদের প্রিমিয়াম কম, কিছু রাজ্য যেমন গুজরাট উচ্চ প্রিমিয়ামের কারণে প্রকল্প থেকে বেরিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে, বাণিজ্যিক ফসলের জন্য ৫% প্রিমিয়াম অনেক কৃষকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
  • বীমা কোম্পানির প্রত্যাহার: ২০১৯ সালে, চারটি বেসরকারি বীমা কোম্পানি পিএমএফবিওয়াই থেকে বেরিয়ে যায়, কারণ তারা এটিকে লোকসানের ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করে। এটি পশ্চিমবঙ্গে প্রকল্পের বাস্তবায়নকে আরও জটিল করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে পিএমএফবিওয়াই-এর পরিসংখ্যান
ইন্ডিয়াস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে পিএমএফবিওয়াই-এর অধীনে কৃষকদের আবেদন, ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ক্লেম রেশিওর তথ্য রেকর্ড করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:

২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ সালে (০৯.০৩.২০২২ পর্যন্ত) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কৃষক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।
২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ সালে রাজ্যে ক্লেম রিপোর্ট করা, প্রদান করা এবং কৃষকদের সুবিধাভোগী সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে।
তবে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত বকেয়া ক্লেমগুলি প্রকল্পের দুর্বলতা নির্দেশ করে।

সমাধানের পথ
পশ্চিমবঙ্গে পিএমএফবিওয়াই-এর কার্যকারিতা বাড়াতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

  • দ্রুত ক্লেম নিষ্পত্তি: ক্লেম প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ এবং দ্রুত করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। স্যাটেলাইট ইমেজারি এবং ড্রোনের মাধ্যমে ক্ষতির মূল্যায়ন ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।
  • সচেতনতা প্রচার: গ্রামীণ এলাকায় কৃষকদের মধ্যে প্রকল্পের সুবিধা এবং আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মসূচি চালানো প্রয়োজন।
  • বীমা কোম্পানির জন্য প্রণোদনা: বীমা কোম্পানিগুলিকে প্রকল্পে ধরে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও আর্থিক সহায়তা বা ঝুঁকি ভাগাভাগি মডেল প্রবর্তন করা যেতে পারে।
  • ছোট কৃষকদের জন্য বিশেষ সুবিধা: পশ্চিমবঙ্গের ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রিমিয়ামে অতিরিক্ত ভর্তুকি বা সহজ আবেদন প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করেছে, বিশেষ করে ফসলের ক্ষতির সময়। তবে, ক্লেম নিষ্পত্তিতে বিলম্ব, সচেতনতার অভাব এবং বীমা কোম্পানিগুলির প্রত্যাহারের মতো চ্যালেঞ্জগুলি প্রকল্পটির কার্যকারিতাকে সীমিত করছে। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ধান, পাট এবং সবজি চাষ প্রধান, এই প্রকল্পটি কৃষকদের আয় স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, সরকার, বীমা কোম্পানি এবং কৃষকদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রকল্পটির ত্রুটিগুলি সংশোধন করা এবং এর প্রভাব আরও বাড়ানো সম্ভব।