চলতিবর্ষে রাজ্যভিত্তিক কৃষি ঋণ – পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান কোথায়?

কৃষি ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যে কৃষি ঋণ কৃষকদের (Agricultural Loans) জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষি ঋণের বণ্টন…

Agricultural Loans by State in 2025

কৃষি ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যে কৃষি ঋণ কৃষকদের (Agricultural Loans) জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষি ঋণের বণ্টন এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে ৭১.২৩ লক্ষ কৃষক পরিবারের ৯৬% ছোট ও প্রান্তিক কৃষক, সেখানে কৃষি ঋণের প্রাপ্যতা এবং এর তুলনা অন্যান্য রাজ্যের সাথে কীভাবে দাঁড়ায়? এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালে কৃষি ঋণের রাজ্যভিত্তিক তথ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ঋণের পরিস্থিতি
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। রাজ্যটি ভারতের ধান উৎপাদনের প্রায় ১৩% এবং আলুর ২০% সরবরাহ করে। ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষি খাতে মোট ব্যয়ের ৭.৪% বরাদ্দ করেছে, যা জাতীয় গড় (৫.৯%) থেকে বেশি। এছাড়া, ২০০০টি কৃষি যন্ত্রপাতি হাব এবং ১২০০টি কৃষক উৎপাদক সংস্থা (FPO) স্থাপনের জন্য যথাক্রমে ৪৫০ কোটি এবং ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই উদ্যোগগুলি কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাজার সংযোগ প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে।

   

২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ঋণ হিসেবে ৪১,১৭৮.৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছিল, যা ২০২১ সালের ২৯,৭৯৫.৪১ কোটি টাকা থেকে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, ২০২০ সালে এই পরিমাণ ছিল ৫৪,৮৪৯.৪২ কোটি টাকা, যা সর্বোচ্চ। ২০২৫ সালে, জাতীয় কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ২০ লক্ষ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এবং পশ্চিমবঙ্গ এই লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

অন্যান্য রাজ্যের সাথে তুলনা
২০২০-২১ সালে ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে কৃষি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮.৪ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০১৫-১৬ সালের ১২ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৫৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে কৃষকদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৬.৯ কোটি থেকে বেড়ে ১০ কোটি হয়েছে। তবে, রাজ্যভিত্তিক তথ্যে দেখা যায়, মহারাষ্ট্রে কৃষি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ৫.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ওড়িশা (৭৬% বৃদ্ধি), তামিলনাড়ু (৬৮%), এবং অন্ধ্রপ্রদেশ (৬৫%)। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এই রাজ্যগুলিতে ঋণ বিতরণ বেশি হলেও, পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ঋণের পরিমাণ স্থিতিশীল এবং ক্রমবর্ধমান।

কর্ণাটক এবং পাঞ্জাবে কৃষি ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৭% এবং ৪.৫% কমেছে, যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পিছিয়ে থাকার ইঙ্গিত দেয়। পশ্চিমবঙ্গে ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ঋণের প্রাপ্যতা বাড়ানোর জন্য সরকার এবং ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট (NABARD) বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (KCC) এবং রাষ্ট্রীয় কৃষি বীমা যোজনার মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ঋণের বৈশিষ্ট্য
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ঋণের বেশিরভাগই ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বিতরণ করা হয়। গড় জমির আকার মাত্র ০.৭৭ হেক্টর হওয়ায়, এই ঋণগুলি কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, এবং বীজ ও সার কেনার জন্য ব্যবহৃত হয়। ২০২৪-২৫ সালে, সরকার ২,০০০টি ফার্ম মেশিনারি হাব স্থাপনের জন্য ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যা কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা প্রদান করবে। এছাড়া, ১২০০টি কৃষক উৎপাদক সংস্থা (FPO) বীজ সরবরাহ এবং বাজার সংযোগ উন্নত করবে।

Advertisements

ন্যাবার্ড এবং বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ঋণ বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০২৫ সালে, ঋণের সুদের হার ৭-১১% এর মধ্যে রয়েছে, এবং সরকারের সুদ ভর্তুকি প্রকল্প কৃষকদের বোঝা কমিয়েছে। তবে, ঋণের প্রক্রিয়াকরণে স্বচ্ছতা এবং দ্রুত বিতরণ নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল সমাধানের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, স্কাইমেট ওয়েদারের মতো অ্যাগ্রিটেক সংস্থাগুলি ফার্ম ক্রেডিট স্কোর তৈরির জন্য জিওস্পেশিয়াল ডেটা ব্যবহার করছে, যা ঋণ বিতরণকে আরও দক্ষ করে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, ছোট কৃষকদের ক্রেডিট ইতিহাসের অভাব ঋণ প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, ঋণের অপব্যবহার এবং জমির মালিকানা যাচাইয়ে জটিলতা রয়েছে। এই সমস্যাগুলি মোকাবিলায় ডিজিটাল কৃষি ঋণ সমাধান, যেমন কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের নবায়ন এবং রিমোট সেন্সিং ডেটার ব্যবহার, কার্যকর হচ্ছে। এছাড়া, ই-ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট (e-NAM) প্ল্যাটফর্মে আরও মণ্ডি সংযুক্ত করার মাধ্যমে কৃষকদের বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ানো হচ্ছে, যা ২০২৪-২৫ সালে ৩ লক্ষ কোটি টাকার বাণিজ্যের লক্ষ্য রাখছে।

অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের শক্তি
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ঋণ বিতরণ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় স্থিতিশীল এবং ক্রমবর্ধমান। মহারাষ্ট্র এবং ওড়িশার মতো রাজ্যগুলিতে ঋণের পরিমাণ বেশি হলেও, পশ্চিমবঙ্গের ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ঋণের প্রাপ্যতা উল্লেখযোগ্য। রাজ্যের কৃষি বাজেট এবং সরকারি উদ্যোগ, যেমন ফার্ম মেশিনারি হাব এবং FPO, কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে। তবে, কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলির থেকে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে রয়েছে ডিজিটাল কৃষি ঋণ প্রক্রিয়াকরণে। এই ক্ষেত্রে আরও উন্নতি প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
২০২৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ঋণ বিতরণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের ২০ লক্ষ কোটি টাকার জাতীয় কৃষি ঋণ লক্ষ্যমাত্রা এবং ন্যাবার্ডের উদ্যোগ কৃষকদের আর্থিক সহায়তা বাড়াবে। ডিজিটাল সমাধান এবং e-NAM-এর মতো প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের বাজারে প্রবেশাধিকার এবং ঋণের স্বচ্ছতা বাড়াবে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য এই উদ্যোগগুলি আর্থিক স্বাধীনতা এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।