জল সংকটে কৃষকদের জন্য কি ড্রিপ সেচ এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহই একমাত্র সমাধান?

ভারতের জল সংকট ক্রমশ গভীর হচ্ছে, এবং এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে কৃষি খাতে, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। নীতি আয়োগের ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে, প্রায়…

Drip Irrigation & Rainwater Harvesting Enough

ভারতের জল সংকট ক্রমশ গভীর হচ্ছে, এবং এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে কৃষি খাতে, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। নীতি আয়োগের ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে, প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ভারতীয় উচ্চ থেকে চরম জল সংকটের সম্মুখীন, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং হায়দ্রাবাদের মতো ২১টি শহরে ভূগর্ভস্থ জল সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে কৃষি অর্থনীতির একটি প্রধান অংশ, জল সংকট কৃষকদের জীবিকা এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতের জল সংকটের কারণ, প্রভাব এবং কৃষকদের জন্য সমাধান হিসেবে ড্রিপ সেচ এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব, সাথে অন্যান্য সম্ভাব্য সমাধানও খতিয়ে দেখব।

ভারতের জল সংকটের কারণ
ভারতের জল সংকটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে:

   
  1. জলবায়ু পরিবর্তন: ভারতের মৌসুমি বৃষ্টির ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে, যা কৃষি ও জল সরবরাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালে ভারত ১৯০১ সালের পর থেকে সবচেয়ে উষ্ণতম বছরের সম্মুখীন হয়েছে, যার ফলে দীর্ঘায়িত খরা এবং তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছে। এটি জলের উপলব্ধতা কমিয়েছে এবং ভূগর্ভস্থ জলের রিচার্জ হ্রাস করেছে।
  2. ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত নিষ্কাশন: ভারত বিশ্বের মোট ভূগর্ভস্থ জল নিষ্কাশনের ২৫% এর জন্য দায়ী। কৃষির জন্য ভূগর্ভস্থ জলের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, জলস্তরকে বিপজ্জনকভাবে হ্রাস করেছে। সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড (CGWB) অনুসারে, ৭৩৬টি মূল্যায়ন ইউনিটে নিষ্কাশন পুনরায় পূরণের চেয়ে বেশি।
  3. অদক্ষ কৃষি পদ্ধতি: ভারতের কৃষি খাত মোট জলের ৮৫% ব্যবহার করে, এবং বন্যা সেচের মতো অদক্ষ পদ্ধতি জলের অপচয় ঘটায়। ধান এবং আখের মতো জল-নিবিড় ফসল শুষ্ক অঞ্চলে চাষ করা জল সংকটকে আরও গভীর করে।
  4. দূষণ: শিল্প নির্গমন, কৃষি রানঅফ এবং অপরিশোধিত পয়ঃনিষ্কাশন ভারতের নদী এবং ভূগর্ভস্থ জলকে দূষিত করছে। সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড (CPCB) জানিয়েছে, ভারতের ৭০% পৃষ্ঠের জল পানের জন্য অনুপযুক্ত।
  5. দ্রুত নগরায়ন: শহরাঞ্চলে জলের চাহিদা বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত নির্মাণ জলাশয় এবং প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস করছে। বেঙ্গালুরুর মতো শহরে ২০২৪ সালে “ডে জিরো” পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, যেখানে কল শুকিয়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে জল সংকটের প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ধান, পাট এবং শাকসবজির চাষ প্রধান, জল সংকট কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং বন্যার কারণে মাটির ক্ষয় এবং জলাবদ্ধতা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করছে। ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত নিষ্কাশন এবং দূষণের কারণে পানীয় জলের সংকটও বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক এবং ফ্লোরাইডের উপস্থিতি স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

  • ড্রিপ সেচ: একটি কার্যকর সমাধান
    ড্রিপ সেচ একটি জল-দক্ষ পদ্ধতি যা ফসলের শিকড়ে সরাসরি জল সরবরাহ করে, অপচয় কমায়। এটি ঐতিহ্যবাহী বন্যা সেচের তুলনায় ৫০-৭০% জল সাশ্রয় করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ধানের মতো জল-নিবিড় ফসল প্রচলিত, ড্রিপ সেচ কৃষকদের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে।
    সুবিধা: ড্রিপ সেচ জলের ব্যবহার কমায়, ফসলের ফলন বাড়ায় এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে। এটি পশ্চিমবঙ্গের শুষ্ক অঞ্চলে বিশেষভাবে কার্যকর, যেখানে জলের অভাব একটি বড় সমস্যা।
  • চ্যালেঞ্জ: ড্রিপ সেচ ব্যবস্থার প্রাথমিক বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হতে পারে, যা ছোট কৃষকদের জন্য একটি বাধা। তবে, সরকারি ভর্তুকি, যেমন প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা (PMKSY), এই খরচ কমাতে সহায়তা করছে।
  • পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ: রাজ্যে ড্রিপ সেচ শাকসবজি এবং ফলের চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়ায় কৃষকরা ড্রিপ সেচের মাধ্যমে জল সাশ্রয় এবং ফলন বৃদ্ধি করছেন।
  • বৃষ্টির জল সংগ্রহ: একটি টেকসই পদ্ধতি
    বৃষ্টির জল সংগ্রহ ভূগর্ভস্থ জলের রিচার্জ এবং জল সংরক্ষণের জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি। এটি বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে জলাশয়, পুকুর বা কূপে সঞ্চয় করে, যা পরে কৃষি এবং পানীয় জলের জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • সুবিধা: বৃষ্টির জল সংগ্রহ ভূগর্ভস্থ জলের রিচার্জ বাড়ায় এবং বন্যার ঝুঁকি কমায়। তামিলনাড়ুতে এই পদ্ধতি ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ৫০% বাড়িয়েছে।
  • পশ্চিমবঙ্গে সম্ভাবনা: রাজ্যের বন্যাপ্রবণ এলাকায় বৃষ্টির জল সংগ্রহ কৃষকদের জন্য একটি বড় সমাধান হতে পারে। পুকুর এবং জলাশয় পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে কৃষকরা বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করতে পারেন। জল শক্তি অভিযানের অধীনে পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
  • চ্যালেঞ্জ: অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সচেতনতার অভাব বৃষ্টির জল সংগ্রহের ব্যাপক গ্রহণে বাধা। স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং সরকারি সহায়তা এই সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ।

ড্রিপ সেচ এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহই কি একমাত্র সমাধান?
যদিও ড্রিপ সেচ এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহ কার্যকর সমাধান, এগুলি একমাত্র উপায় নয়। জল সংকট মোকাবিলায় আরও কিছু টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে:

Advertisements
  1. ফসল বৈচিত্র্যকরণ: জল-নিবিড় ফসলের পরিবর্তে মিলেট, ডাল এবং তৈলবীজের মতো কম জল-নিবিড় ফসল চাষ করা উচিত। পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা ধানের পাশাপাশি মসুর এবং তিল চাষ করতে পারেন।
  2. পুকুর এবং জলাশয় পুনরুজ্জীবন: ঐতিহ্যবাহী জলাশয় এবং পুকুর পুনরুদ্ধার জল সংরক্ষণে সহায়ক। তেলেঙ্গানার মিশন কাকাতিয়া এই ধরনের একটি সফল উদ্যোগ।
  3. প্রযুক্তি ব্যবহার: স্মার্ট মিটার এবং সেন্সর জলের ব্যবহার নিরীক্ষণ এবং ফুটো সনাক্ত করতে সহায়ক। জিআইএস প্রযুক্তি জল সম্পদের ম্যাপিং এবং টেকসই ব্যবহারে সহায়তা করতে পারে।
  4. সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা: জল ব্যবহারকারী সমিতি (Water User Associations) এবং সম্প্রদায়-চালিত উদ্যোগ জল বণ্টন এবং সংরক্ষণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে।
  5. নীতি সংস্কার: জলের মূল্য নির্ধারণ এবং বিদ্যুৎ ভর্তুকি সংস্কার অপচয় কমাতে পারে। পাঞ্জাবের “পানি বাঁচাও, পয়সা কমাও” প্রকল্প এই দিকে একটি সফল উদাহরণ।

পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ
পশ্চিমবঙ্গে জল সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় চাহিদা এবং ভৌগলিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সরকারি প্রকল্প যেমন জল শক্তি অভিযান এবং অটল ভূজল যোজনা কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং ভর্তুকি প্রদান করছে। এছাড়া, স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং কৃষক সমিতির মাধ্যমে বৃষ্টির জল সংগ্রহ এবং ড্রিপ সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

ভারতের জল সংকট, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য, একটি জটিল সমস্যা যা একক সমাধানের মাধ্যমে মোকাবিলা করা যায় না। ড্রিপ সেচ এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহ কার্যকর হলেও, ফসল বৈচিত্র্যকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মতো অন্যান্য পদ্ধতির সমন্বয় প্রয়োজন। সরকার, কৃষক, এবং সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা জল সংকট মোকাবিলায় এবং টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই পদ্ধতিগুলি গ্রহণ করলে কৃষকরা জল সংকটের প্রভাব কমাতে এবং তাদের জীবিকা সুরক্ষিত করতে পারবেন।