ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় ক্রমাগত মাটির উর্বরতা (India’s Soil Fertility) হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে একাধিক কেন্দ্রীয় সংস্থা। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ICAR) প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানানো হয়েছে, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির জৈব উপাদানের ঘাটতি ক্রমশই তীব্র আকার নিচ্ছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে ভারতে প্রতি কেজি রাসায়নিক সারের পরিবর্তে গড়ে ১৩.৪ কেজি ফসল উৎপন্ন হতো। কিন্তু ২০০৭ সাল নাগাদ সেই পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.৭ কেজিতে। অর্থাৎ, আগের মতো পরিমাণ সার ব্যবহার করেও কৃষকরা আগের মতো ফলন পাচ্ছেন না। এই পরিসংখ্যানই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, অতিরিক্ত ও অবিবেচিত কৃষিজ চাষাবাদের ফলে ভারতের মাটির উর্বরতা দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে।
২০১৯ সালে ICAR পরিচালিত একটি গবেষণায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সারের ব্যবহারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির জৈব কার্বনের (Soil Organic Carbon) পরিমাণ গত কয়েক দশকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। মাটির জৈব কার্বন কমে যাওয়ার অর্থই হল মাটির স্বাভাবিক গঠন ও পুষ্টির ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে ফলনও হ্রাস পাচ্ছে।
এ বিষয়ে Journal of Soil Science-এ ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানানো হয়েছে, সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে এখন পর্যন্ত nutrient use efficiency বা পুষ্টি-উপযোগিতার হার প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ আগের মতো সার দিলেও, সেই সার থেকে গাছ কতটা উপকার পাচ্ছে—তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। এতে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনই দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাও ধাক্কা খাচ্ছে।
তবে এই প্রবণতা রুখতে কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০২৩ সালে ন্যাশনাল মিশন ফর সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার (NMSA) নামে একটি নতুন উদ্যোগ চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল কৃষকদের রাসায়নিক সার থেকে ধীরে ধীরে জৈব সার ও বায়োফার্টিলাইজারের দিকে আগ্রহী করে তোলা, যাতে মাটির প্রাকৃতিক গঠন ও পুষ্টিগুণ ফেরানো যায়।
এই মিশনের আওতায় মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, গুজরাট, ওড়িশা সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলির প্রাথমিক রিপোর্ট ইতিমধ্যেই আশার আলো দেখাচ্ছে। মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে চালু প্রকল্পগুলিতে দেখা গেছে, জৈব পদ্ধতি অবলম্বন করার পর ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও, গবেষকরা মনে করছেন, মাটির স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন না নিলে ভবিষ্যতে ভারতের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আরও বিপদের মুখে পড়তে পারে। তারা বলছেন, মাটির প্রাকৃতিক জৈব উপাদানকে ফিরিয়ে আনার জন্য শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়, দরকার কৃষকদের সচেতনতা এবং সরকারি নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন।
অন্যদিকে, কৃষক সংগঠনগুলিও দাবি তুলেছে, জৈব সার এবং বায়োফার্টিলাইজারের সহজলভ্যতা ও কম দামে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে, চাষিদের মধ্যে এই পদ্ধতির প্রতি আস্থা তৈরি করা কঠিন হবে।
মোট কথা, ভারতের কৃষি আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। সরকার ও কৃষক—দুই পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে ভারতীয় কৃষিকে আবার টেকসই ও লাভজনক করে তুলতে।