ভারতের নয়া এমএসপি নীতিতে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর এর প্রভাব

ভারত সরকার ২০২৫-২৬ রবি মরসুমের জন্য ছয়টি ফসলের জন্য নতুন ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP Policy) ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে গম, বার্লি, ছোলা, মসুর, সরিষা এবং…

Rising Fertilizer Prices Threaten Indian Farmers’ Survival in 2025 Crisis

ভারত সরকার ২০২৫-২৬ রবি মরসুমের জন্য ছয়টি ফসলের জন্য নতুন ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP Policy) ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে গম, বার্লি, ছোলা, মসুর, সরিষা এবং কুসুম রয়েছে। গমের এমএসপি প্রতি কুইন্টালে ১৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ২,৪২৫ টাকা এবং সরিষার এমএসপি ৩০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫,৯৯০ টাকা হয়েছে। এই নীতি কৃষকদের জন্য ন্যূনতম মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে, যাতে বাজারের মূল্য হ্রাসের সময় তারা ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। তবে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য এই নীতির প্রভাব কতটা ইতিবাচক বা চ্যালেঞ্জিং হবে? এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের প্রেক্ষাপটে এই নীতির সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করব।

পশ্চিমবঙ্গে এমএসপি নীতির বর্তমান অবস্থা
পশ্চিমবঙ্গে ধান এবং সরিষার মতো ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য, তবে এমএসপি সুবিধা গ্রহণকারী কৃষকদের সংখ্যা খুবই কম। ২০১৮-১৯ সালের জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের (এনএসএসও) সার্ভে অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১% কৃষক ধানের জন্য এমএসপি সুবিধা পেয়েছেন। এর প্রধান কারণ হল রাজ্যে ক্রয় ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং কৃষকদের মধ্যে এমএসপি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো রাজ্যে, যেখানে ক্রয় ব্যবস্থা শক্তিশালী, ৯৫% পর্যন্ত কৃষক এমএসপি সুবিধা পান। পশ্চিমবঙ্গে এই সুবিধা প্রায় নগণ্য।

   

নতুন এমএসপি নীতি ২০২৫-২৬ মরসুমে সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করতে পারে, কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরিষার অন্যতম প্রধান উৎপাদক রাজ্য। তবে, কৃষকদের এই সুবিধা পেতে হলে ক্রয় কেন্দ্র, স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি অত্যন্ত জরুরি।

ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮৫% কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, যাদের জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের কম। এই কৃষকরা প্রায়শই মধ্যস্থতাকারী বা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর করে ফসল বিক্রি করেন, যারা এমএসপি-র তুলনায় কম মূল্যে ফসল কেনেন। এনএসএসও তথ্য অনুযায়ী, ৪০% কৃষক এখনও অ-প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের উপর নির্ভরশীল, যারা প্রায়শই ব্যবসায়ী বা ইনপুট ডিলার হয়ে থাকেন। এই ঋণের বিনিময়ে কৃষকরা তাদের ফসল কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

নতুন এমএসপি নীতি তাত্ত্বিকভাবে কৃষকদের আয় বাড়াতে পারে, তবে পশ্চিমবঙ্গে এর সফলতা নির্ভর করছে ক্রয় ব্যবস্থার উন্নতির উপর। উদাহরণস্বরূপ, ছত্তিশগড়ে বিকেন্দ্রীকৃত ক্রয় ব্যবস্থা (ডিসিপি) চালু হওয়ার পর ৩৮% কৃষক ধানের জন্য এমএসপি সুবিধা পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ক্ষুদ্র কৃষকরা উপকৃত হতে পারেন।

Advertisements

চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা
১. ক্রয় ব্যবস্থার অভাব: পশ্চিমবঙ্গে এমএসপি-ভিত্তিক ক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এফসিআই) এবং ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল কো-অপারেটিভ মার্কেটিং ফেডারেশন (নাফেড) এর মতো সংস্থাগুলোর উপস্থিতি সীমিত। ফলে, কৃষকরা বাজারে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন।
২. সচেতনতার অভাব: ২০১৩ সালের এনএসএস সার্ভে অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ধান ও গমের জন্য এমএসপি সম্পর্কে মাত্র ২৩% কৃষক সচেতন। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে এই সচেতনতা আরও কম।
৩. ফসলের সীমিত কভারেজ: এমএসপি ২৩টি ফসলের জন্য ঘোষিত হলেও, পশ্চিমবঙ্গে শুধুমাত্র ধান এবং সরিষার ক্রয়ই উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য ফসল, যেমন ডাল, তৈলবীজ বা তুলা, এমএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
৪. বাজার বিকৃতি: এমএসপি বৃদ্ধি ফসলের বৈচিত্র্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে ধানের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ইতিমধ্যেই মাটির উর্বরতা এবং জলস্তরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সম্ভাব্য সুবিধা
নতুন এমএসপি নীতি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য কিছু সুযোগ তৈরি করতে পারে। সরিষার এমএসপি বৃদ্ধি কৃষকদের এই ফসল চাষে উৎসাহিত করতে পারে, যা ভারতের তৈলবীজের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। এছাড়া, এমএসপি বৈধকরণের দাবি যদি পূরণ হয়, তবে কৃষকরা বাজারে কম দামে ফসল বিক্রির ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাবেন। এটি কৃষকদের আয় স্থিতিশীল করতে এবং ঋণের বোঝা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

সমাধানের পথ
১. ক্রয় ব্যবস্থার উন্নতি: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত বিকেন্দ্রীকৃত ক্রয় ব্যবস্থা (ডিসিপি) শক্তিশালী করা, যাতে আরও কৃষক এমএসপি সুবিধা পান।
২. সচেতনতা বৃদ্ধি: কৃষকদের মধ্যে এমএসপি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা এবং কৃষি সম্প্রসারণ পরিষেবা জোরদার করা প্রয়োজন।
৩. অবকাঠামো উন্নয়ন: ক্রয় কেন্দ্র, স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করলে কৃষকরা সরাসরি এমএসপি সুবিধা পেতে পারেন।
৪. ফসল বৈচিত্র্যকরণ: ধানের উপর নির্ভরতা কমাতে সরিষা, ডাল এবং অন্যান্য তৈলবীজের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রণোদনা দেওয়া উচিত।

ভারতের নতুন এমএসপি নীতি ২০২৫ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করলেও, এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে রাজ্যের ক্রয় ব্যবস্থা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উপর। বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গে এমএসপি সুবিধা সীমিত, এবং ক্ষুদ্র কৃষকরা মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভরশীল। সরকারি হস্তক্ষেপ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই নীতি কৃষকদের আয় বাড়াতে এবং কৃষি খাতকে শক্তিশালী করতে পারে। তবে, এমএসপি বৈধকরণ এবং ফসল বৈচিত্র্যকরণের দাবি পূরণ না হলে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য এই নীতির পূর্ণ সুবিধা পাওয়া কঠিন হবে।