ভারতের দুগ্ধ শিল্প (Dairy industry) যা বিশ্বের বৃহত্তম দুধ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত, বর্তমানে একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি। দেশের প্রায় ৮০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক দুগ্ধ খামারি (Dairy Farmers) নিম্ন দুধের দামের কারণে জীবিকার উপর তীব্র চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই সংকটের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যার মধ্যে রয়েছে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ, রপ্তানির হ্রাস এবং বিশ্ববাজারে স্কিমড মিল্ক পাউডারের (এসএমপি) দাম হ্রাস। এই পরিস্থিতিতে দুগ্ধ শিল্পের (Dairy industry) বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এবং সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি তুলেছেন।
Dairy industry: নিম্ন দুধের দামের প্রভাব
ভারতের দুগ্ধ শিল্প (Dairy industry) গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এটি দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় ৫% অবদান রাখে এবং ৮ কোটিরও বেশি কৃষকের জীবিকার প্রধান উৎস। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দুধের ক্রয়মূল্য কমে যাওয়ায় কৃষকরা তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে গত কয়েক বছরে গরুর দুধের ক্রয়মূল্য প্রতি লিটারে ২৪-২৫ টাকা থেকে কমে ১৭-২০ টাকায় নেমে এসেছে, যেখানে মহিষের দুধের দাম ৪১-৪২ টাকা থেকে কমে ৩৪-৩৬ টাকায় এসেছে। এই দামের পতন কৃষকদের জন্য উৎপাদন ব্যয় মেটানো কঠিন করে তুলেছে, কারণ পশুখাদ্য, শ্রম এবং অন্যান্য খরচ ক্রমাগত বাড়ছে।

২০২০-২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় দুগ্ধ শিল্পে (Dairy industry) চাহিদা হ্রাসের ফলে এই সংকট আরও তীব্র হয়। লকডাউনের কারণে রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান এবং আইসক্রিম শিল্পের মতো প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতাদের চাহিদা প্রায় ৪০% কমে যায়। ফলে কৃষকরা তাদের দুধ বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকের মতো রাজ্যে এই ধরনের বিক্ষোভ দেখা গেছে।
শিল্পের প্রতিক্রিয়া
দুগ্ধ শিল্পের (Dairy industry) বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং সংগঠনগুলি এই সংকটের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অল-ইন্ডিয়া প্রোগ্রেসিভ ডেয়ারি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (পিডিএফএ) সদস্য এস. দলজিৎ সিং প্রতি লিটারে কমপক্ষে ৭ টাকা ভর্তুকির দাবি জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বিশ্ববাজারে স্কিমড মিল্ক পাউডারের দাম হ্রাসের কারণে ভারতের রপ্তানি কমে গেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ২ লাখ টন এসএমপি মজুদ তৈরি করেছে। এই অতিরিক্ত মজুদ তরল দুধের বাজারেও চাপ সৃষ্টি করছে।
গুজরাট কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশনের (জিসিএমএমএফ) প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর.এস. সোধি জানিয়েছেন যে কৃষকরা এখন ভালো দাম পাচ্ছেন, যা আগামী শীতকালে দুধের উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে, তিনি ২০২৪ সালে শিল্পের স্বাভাবিক ৬-৭% বৃদ্ধির আশা করছেন না। অন্যদিকে, এক্সকিউ-এর শঙ্কর মনে করেন যে উৎসবের মরসুমে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দুধের দাম নরম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সরকারি হস্তক্ষেপ ও সমাধানের প্রস্তাব
সরকার এই সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেটে দুগ্ধ শিল্পের (Dairy industry) অবকাঠামো উন্নয়ন, পশু প্রজনন, স্বাস্থ্যসেবা এবং পশুখাদ্য সরবরাহের জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গোকুল মিশন, জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড (এনডিডিবি), এবং জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন প্রোগ্রাম (এনপিডিডি) এর মতো স্কিমগুলি কৃষকদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে। এছাড়াও, কম সুদে ঋণ এবং বিপণন ও গুণমান নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
২০২৪ সালে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতের আবহাওয়া বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত পশুখাদ্যের প্রাপ্যতা বাড়িয়েছে, যা দুধ উৎপাদনের জন্য ইতিবাচক। তবে, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ (এফএমডি) এবং ব্রুসেলোসিসের মতো রোগ এখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। ২০২৩ সালে লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) প্রাদুর্ভাবের পরে সরকার বিনামূল্যে টিকাকরণের ব্যবস্থা করেছে, যা পশুমৃত্যু হ্রাসে সহায়ক হয়েছে।
কৃষকদের জন্য সরাসরি ভর্তুকির দাবি উঠলেও, সরকার রপ্তানি প্রণোদনা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। ২০১৮ সালে হুই মিল্ক পাউডারের উপর আমদানি শুল্ক ৩০% থেকে ৪০% বাড়ানো হয় এবং মধ্যাহ্ন ভোজন প্রকল্পে দুধ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলি অতিরিক্ত এসএমপি মজুদ শোষণে সহায়ক হতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পথ
ভারতের দুগ্ধ শিল্পের (Dairy industry) সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, বিশ্ববাজারে নিম্ন দামের কারণে রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে, যা দেশীয় বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং চাহিদা হ্রাস কৃষকদের উপর প্রভাব ফেলেছে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি যেমন আরসিইপি বা ইউএস-ইন্ডিয়া ট্রেড ডিলের মাধ্যমে আমদানি বাড়লে কৃষকদের জন্য আরও ক্ষতি হতে পারে।
দুগ্ধ শিল্পের (Dairy industry) বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে কৃষকদের জন্য স্থিতিশীল বাজার এবং ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়াও, পশুখাদ্য এবং পশুচিকিৎসা পরিষেবার নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ প্রয়োজন। সরকারের উচিত দুগ্ধ সমবায়গুলিকে শক্তিশালী করা এবং কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার দেওয়া। মধ্যাহ্ন ভোজন প্রকল্পে দুধ অন্তর্ভুক্ত করা এবং আঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে দুধ বিতরণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো যেতে পারে।
ভারতের দুগ্ধ শিল্প (Dairy industry) একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কৃষকরা নিম্ন দাম এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির দ্বৈত চাপের মুখোমুখি। সরকারি উদ্যোগ এবং শিল্পের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, কৃষকদের জন্য স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। আগামী বছরগুলিতে দুগ্ধ শিল্পের (Dairy industry) স্থিতিশীলতা এবং কৃষকদের জীবিকা রক্ষায় সরকার, সমবায় এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।