ভারত সরকার ২০২৫ সালে জৈব কৃষির জন্য একটি নতুন ভর্তুকি (Organic Farming Subsidy) প্রকল্প চালু করেছে, যা কৃষকদের রাসায়নিক মুক্ত কৃষি পদ্ধতির দিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই প্রকল্পটি জৈব সার, জৈব কীটনাশক এবং ভার্মিকম্পোস্টের ব্যবহার প্রচারের মাধ্যমে টেকসই কৃষি এবং মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখার উপর জোর দিয়েছে। ভারতে জৈব খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত সচেতনতার কারণে এই প্রকল্পটি কৃষকদের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই প্রকল্পের সুবিধা, যোগ্যতা এবং আবেদন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
২০২৫ সালের জৈব কৃষি ভর্তুকি প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হল কৃষকদের রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের উপর নির্ভরতা কমিয়ে জৈব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করা। এই প্রকল্পটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ রোধ এবং জৈব উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। জাতীয় টেকসই কৃষি মিশন (এনএমএসএ)-এর অধীনে পরিচালিত এই প্রকল্পটি জৈব সার উৎপাদন ইউনিট এবং জৈব কৃষি পদ্ধতির প্রচারের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
প্রকল্পের মূল বৈশিষ্ট্য
১. জৈব সারে ভর্তুকি: কৃষকরা প্রত্যয়িত জৈব সার, ভার্মিকম্পোস্ট, গোবর-ভিত্তিক কম্পোস্ট এবং সবুজ সার ক্রয়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি পাবেন। এই ভর্তুকি কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করবে।
২. জৈব কৃষি ইউনিট স্থাপন: জৈব সার এবং জৈব কীটনাশক উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের জন্য ২৫-৩৩ শতাংশ মূলধন ভর্তুকি প্রদান করা হবে, যা সর্বোচ্চ ৪৫ লক্ষ টাকা (জৈব সারের জন্য) এবং ৬৫ লক্ষ টাকা (ফল ও সবজি বর্জ্য কম্পোস্ট ইউনিটের জন্য) পর্যন্ত হতে পারে।
৩. প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা: কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (কেভিকে) এবং অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং সচেতনতা প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রোগ্রামগুলি জৈব কৃষি পদ্ধতি এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কৃষকদের শিক্ষিত করবে।
৪. স্থানীয় ভাষায় সহায়তা: স্থানীয় ভাষায় পোস্টার, ব্রোশিওর এবং গাইড বিতরণ করা হচ্ছে, যাতে বাংলার কৃষকরা সহজেই এই প্রকল্পের সুবিধা বুঝতে পারেন।
৫. রপ্তানি সহায়তা: জৈব সার্টিফিকেশনের মান পূরণে সহায়তা করে এই প্রকল্প কৃষকদের জৈব পণ্য রপ্তানির সুযোগ প্রদান করছে, যা তাদের আয় বাড়াতে সহায়ক।
যোগ্যতার মানদণ্ড
এই ভর্তুকি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্য কৃষকদের নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করতে হবে:
ভারতীয় নাগরিক এবং সক্রিয়ভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত হতে হবে।
জমির মালিকানা বা লিজ চুক্তির বৈধ নথি থাকতে হবে।
রাজ্যের কৃষি বিভাগের পোর্টালে নিবন্ধিত হতে হবে।
আধার-লিঙ্কযুক্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে, যাতে ডিবিটি (ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার) পেমেন্ট গ্রহণ করা যায়।
জৈব কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক নয়, তবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
কৃষক উৎপাদক সংগঠন (এফপিও), সমবায় সমিতি এবং স্ব-সহায়ক গোষ্ঠী (এসএইচজি)ও যৌথভাবে আবেদন করতে পারে।
আবেদন প্রক্রিয়া
কৃষকরা অনলাইন এবং অফলাইন উভয় পদ্ধতিতে এই ভর্তুকির জন্য আবেদন করতে পারেন। অনলাইন আবেদনের জন্য:
রাজ্য কৃষি বিভাগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যান।
প্রকল্পের জন্য নিবন্ধন ফর্ম পূরণ করুন।
প্রয়োজনীয় নথি, যেমন প্রকল্প পরিকল্পনা, আধার কার্ড, জমির নথি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিবরণ এবং পাসপোর্ট সাইজের ছবি আপলোড করুন।
আবেদন জমা দেওয়ার পর, ব্যাঙ্ক এবং নাবার্ড (NABARD) এটি যাচাই করবে।
অফলাইন আবেদনের জন্য, কৃষকরা নিকটস্থ কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (কেভিকে), সাধারণ সেবা কেন্দ্র (সিএসসি) বা পঞ্চায়েত অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। ভর্তুকি দুটি কিস্তিতে প্রদান করা হয়: প্রথম ৫০ শতাংশ প্রকল্প শুরুর সময় এবং বাকি ৫০ শতাংশ ব্যাঙ্কের যাচাইয়ের পর।
বাংলার কৃষকদের জন্য সুযোগ
পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এই প্রকল্পটি কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার গ্রামীণ এলাকায় জৈব কৃষির চাহিদা বাড়ছে, এবং এই ভর্তুকি কৃষকদের জৈব পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান সরবরাহ করবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলার কৃষকরা ধান, সবজি এবং ফলের জৈব চাষে মনোনিবেশ করে অতিরিক্ত আয় অর্জন করতে পারেন। এছাড়াও, জৈব সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাবেন।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
যদিও এই প্রকল্পটি আশাব্যঞ্জক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জৈব কৃষি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, জমি অধিগ্রহণের জটিলতা এবং বাজারজাতকরণের সমস্যা কৃষকদের জন্য বাধা হতে পারে। এই সমস্যা মোকাবেলায় সরকার দূরদর্শন কৃষি এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছে। এছাড়াও, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রগুলি কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ প্রদান করছে।
২০২৫ সালের জৈব কৃষি ভর্তুকি প্রকল্প ভারতের কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। এটি শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা প্রদান করে না, বরং টেকসই কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখে। বাংলার কৃষকদের জন্য এই প্রকল্পটি জৈব চাষের মাধ্যমে তাদের আয় বাড়ানোর এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের একটি সুবর্ণ সুযোগ। সঠিক প্রশিক্ষণ, সচেতনতা এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে, এই প্রকল্পটি ভারতের কৃষি খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।