নয়াদিল্লি: ভারত সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। আয়ুষ মন্ত্রী প্রতাপরাও জাদব মঙ্গলবার ঘোষণা করেছেন যে, স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে আয়ুর্বেদকে অন্তর্ভুক্ত (Ayurveda in Indian education) করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সরকারের দাবি, এই সিদ্ধান্ত ভারতের হাজার বছরের প্রাচীন চিকিৎসা ঐতিহ্যকে পুনর্জাগরণের পথে এগিয়ে দেবে এবং তরুণ প্রজন্মকে সুস্থ জীবনযাপনের এক বিকল্প ধারার সঙ্গে পরিচিত করবে। তবে, ঘোষণার পরপরই চিকিৎসক সমাজ, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আয়ুর্বেদের অন্তর্ভুক্তি: সরকারের পরিকল্পনা
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পরিষদ (NCERT) এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (UGC) যৌথভাবে নতুন পাঠ্যক্রম তৈরি করছে। এই পাঠ্যক্রমে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত ধাপে ধাপে আয়ুর্বেদের মৌলিক ধারণা, স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্যাভ্যাস ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার দিক তুলে ধরা হবে।
সরকার মনে করছে, আয়ুর্বেদ ও যোগ ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তাই এগুলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা জাতীয় শিক্ষা নীতি (NEP) ২০২০-এর লক্ষ্য পূরণেরই অংশ।
ইতিমধ্যেই গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মতো কয়েকটি রাজ্য তাদের সিলেবাসে আয়ুর্বেদ ও যোগকে প্রায়োগিকভাবে যুক্ত করেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এবার জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সমালোচনা: বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব
কিন্তু এই পদক্ষেপ ঘিরে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়েছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (IMA) ও একাধিক চিকিৎসক সংগঠন মনে করছে, পর্যাপ্ত ক্লিনিক্যাল প্রমাণ ছাড়া আয়ুর্বেদকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা বিপজ্জনক হতে পারে।
২০১১ সালে ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ হেলথ (NCCIH) প্রকাশিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আয়ুর্বেদের অনেক দাবিই বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই করা হয়নি। সমালোচকদের বক্তব্য— ছাত্রদের বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা গড়ে তুলতে হলে পরীক্ষিত তথ্যভিত্তিক শিক্ষা প্রয়োজন, অনুমান বা ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নয়।
তাঁদের মতে, এমবিবিএস ও বিএএমএস কোর্সের সামঞ্জস্য আনার যে প্রস্তাব রয়েছে, তা চিকিৎসা শিক্ষার মান কমিয়ে দিতে পারে।
সমর্থনের যুক্তি: ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ
অন্যদিকে আয়ুর্বেদের সমর্থকরা বলছেন, এটা শুধু পাঠ্যক্রমে একটি বিষয় যোগ করা নয়, বরং ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের পুনর্জাগরণ। তাঁদের মতে—
- আয়ুর্বেদ ৫০০০ বছরের পুরনো চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা কেবল রোগ সারানো নয়, সুস্থ জীবনযাপন ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যচর্চার পথ দেখায়।
- আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি যদি আয়ুর্বেদের ব্যবহার শেখানো হয়, তবে তা একে অপরকে সম্পূরক করতে পারবে।
- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আয়ুর্বেদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বহু পশ্চিমী দেশে এখন আয়ুর্বেদিক থেরাপি ও খাদ্যাভ্যাসের গবেষণা চলছে।
আয়ুষ মন্ত্রণালয়ও আশ্বাস দিয়েছে যে, আয়ুর্বেদকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে উপস্থাপন করা হবে। এর পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে প্রমাণভিত্তিক গবেষণা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভারতে আয়ুর্বেদ কেবল চিকিৎসা নয়, বরং জীবনদর্শন। সংস্কৃত শব্দ “আয়ু” অর্থ জীবন, আর “বেদ” অর্থ জ্ঞান। অর্থাৎ, আয়ুর্বেদ মানে জীবন সম্পর্কে জ্ঞান।
প্রাচীন গ্রন্থ চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা আজও বিশ্বজুড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত। অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্ম কৌশল থেকে শুরু করে ভেষজ ওষুধের ব্যবহার— আয়ুর্বেদের প্রভাব ভারতীয় সমাজে গভীর।
তবে ঔপনিবেশিক শাসনকালে পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির প্রভাব বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে আয়ুর্বেদ প্রান্তিক হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকটি সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলেও আয়ুর্বেদ কখনোই মূলধারার চিকিৎসা শিক্ষায় জায়গা পায়নি। এবার সেই শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করছে সরকার।
শিক্ষা ও সমাজে সম্ভাব্য প্রভাব
এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় কয়েকটি বড় পরিবর্তন আসতে পারে—
- পাঠ্যক্রমে বৈচিত্র্য
ছাত্ররা শুধু আধুনিক বিজ্ঞানের পাঠই নয়, বরং ঐতিহ্যবাহী স্বাস্থ্যচর্চা সম্পর্কেও জানতে পারবে। - গবেষণার প্রসার
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আয়ুর্বেদ নিয়ে গবেষণা বাড়বে। এতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতারও সুযোগ তৈরি হতে পারে। - সচেতনতা বৃদ্ধি
স্বাস্থ্য ও জীবনধারার ক্ষেত্রে প্রাচীন জ্ঞানের গুরুত্ব নিয়ে ছাত্রদের সচেতনতা বাড়বে। - চ্যালেঞ্জ
পাঠ্যক্রমকে বৈজ্ঞানিক মানদণ্ডে দাঁড় করানো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মানসম্মত গবেষণা ইত্যাদি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
চীন তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথাগত চীনা চিকিৎসা (TCM) অন্তর্ভুক্ত করেছে বহু বছর আগে। কোরিয়া, জাপান এমনকি ইউরোপের কিছু দেশেও বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখানো হয়। ভারতও সেই পথে হাঁটতে চাইছে। তবে পার্থক্য হলো— ঐ দেশগুলোতে বিকল্প চিকিৎসা আধুনিক গবেষণার কঠোর মানদণ্ডে যাচাই করা হয়েছে, যেখানে ভারতে এখনো অনেক পথ বাকি।
🚨 Ayurveda education is soon to be introduced in Indian schools and colleges. (NCERT) pic.twitter.com/2cEhT1jIbG
— Indian Tech & Infra (@IndianTechGuide) October 1, 2025
সমালোচক বনাম সমর্থক: বিতর্ক চলছেই
সমালোচকদের বক্তব্য: “অপরীক্ষিত তত্ত্ব শেখানো হলে ছাত্ররা বিভ্রান্ত হবে। এর ফলে ভবিষ্যতের চিকিৎসা ব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।”
সমর্থকদের বক্তব্য: “আয়ুর্বেদকে বাতিল করা মানে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা। শিক্ষা ব্যবস্থায় এর অন্তর্ভুক্তি প্রাচীন জ্ঞানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।”
ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে—
- শিক্ষকদের সঠিক প্রশিক্ষণ,
- পাঠ্যক্রমের মানকরণ,
- বৈজ্ঞানিক প্রমাণভিত্তিক উপস্থাপন,
- এবং আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর।
এখন প্রশ্ন হল, এই পদক্ষেপ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন ইতিহাস গড়বে, নাকি প্রবল বিতর্কের ভিড়ে মিলিয়ে যাবে? আপাতত সময়ই সেই উত্তর দেবে।
🎯Ayurveda in Indian education 2025, India Ayurveda school curriculum, Ayurveda syllabus UGC NCERT,Ayurveda in National Education Policy 2020, India traditional medicine education reform, Ayurveda vs modern medicine debate India, Ministry of AYUSH education initiatives, Ayurveda courses in Indian universities