বিশ্বের ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত (India Rice Production) এবার চিনকে ছাড়িয়ে প্রথম স্থান দখল করেছে, এবং এর পেছনে বাংলার অবদান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভারত ২০৬.৭৩ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন করেছে, যা চীনের ২০৬.৬০ মিলিয়ন টনের তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। এই সামান্য পার্থক্যটিও ভারতের কৃষি অর্থনীতির শক্তি ও বৈচিত্র্যকে প্রমাণ করে। এই সাফল্যের মূলে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ধান উৎপাদন, যা দেশের মোট উৎপাদনের এক বড় অংশ নিয়ে গড়ে।
পশ্চিমবঙ্গ, যাকে প্রাচীনকাল থেকে “অন্ন ভাণ্ডার” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এখনও ধান উৎপাদনে দেশের সেরা রাজ্যগুলোর একটি। ২০২৩ সালে রাজ্যটি প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন করেছে, যা ভারতের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭-৮% নির্দিষ্ট করে। এই অঞ্চলের উর্বর মাটি, প্রচুর বৃষ্টি এবং কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এই সাফল্যের ভিত্তি। বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গের জলোচ্ছ্বাস ও উত্তর বঙ্গের পাহাড়ি এলাকার টেরেস চাষ পদ্ধতি ধান উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাংলার কৃষকরা প্রাচীন কৃষি জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ, সার এবং সেচ ব্যবস্থার সমন্বয়ে এই অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেছেন।
ধান উৎপাদনে ভারতের এই অগ্রগতি শুধু পরিমাণের দিক থেকেই নয়, গুণমানের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত ধানের জাতগুলো, যেমন গোবিন্দভোগ, তুলসী মাল, এবং কালনামক, আন্তর্জাতিক বাজারে তার গন্ধ ও স্বাদের জন্য বিখ্যাত। এই স্থানীয় জাতগুলোর সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বাংলার কৃষি বিজ্ঞানীরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, বাংলার কৃষকরা আবহাওয়া পরিবর্তনের মোকাবিলায় স্থানীয় ধানের জাতগুলোর সংরক্ষণে সফল হয়েছেন, যা প্লাবন, খরা এবং লোনা মাটির প্রতিরোধী। এই কারণে, বাংলার ধান উৎপাদন দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি স্থিতিশীল ভিত্তি তৈরি করেছে।
এই সাফল্যের পেছনে কেবল প্রকৃতির সাহায্য নয়, সরকারি নীতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষকদের জন্য সরাসরি আর্থিক সহায়তা, উন্নত সেচ ব্যবস্থা এবং বীজ বিতরণে গুরুত্ব আরোপ করেছে। ২০২৪ সালে চালু হওয়া “কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প” এর মাধ্যমে হাজার হাজার কৃষক বিনামূল্যে উচ্চমানের বীজ পেয়েছেন, যা উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া, স্থানীয় সহযোগিতা সংস্থাগুলো কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে লিপ্ত, যা উৎপাদন পদ্ধতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
চীনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ভারতের জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও প্রতি ব্যক্তির জন্য ধানের উপলব্ধতা এখানে বেশি। এটি বাংলার কৃষকদের পরিশ্রম এবং সরকারি উদ্যোগের ফল। তবে, এই সাফল্যের সঙ্গে চ্যালেঞ্জও জড়িত। আবহাওয়া পরিবর্তন, পানি সংকট এবং কৃষি জমির কমে যাওয়া ভবিষ্যতে উৎপাদনের জন্য হুমকি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, স্থায়ী কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ এবং জলবায়ু-প্রতিরোধী ফসলের উন্নয়নে আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বাংলার ধান উৎপাদনের কাহিনী শুধু ভারতের জন্যই নয়, বিশ্বের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস। এই অঞ্চলের কৃষকরা প্রমাণ করেছেন যে, প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করলে কীভাবে একটি দেশকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করা যায়। ভবিষ্যতে, বাংলার এই কৃষি উৎপাদন বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সুতরাং, এই সাফল্যকে ধরে রাখতে এবং আরও উন্নত করতে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে ভারত ধান উৎপাদনে বিশ্বসেরার পদমর্যাদা অটুট রাখতে পারে।