ভারতকে বিশ্বের “ফুড বাস্কেট” (Global Food Basket) এ রূপান্তর করার উচ্ছ্বাসী পরিকল্পনা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষি ও গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে দৈনিক ভাস্করের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানিয়েছেন, ভারতের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতি দ্বারা শীঘ্রই দেশটি অন্যান্য রাষ্ট্রের ভোজনের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হবে। এই ঘোষণা সারা দেশে বিতর্কের উদ্রেক করেছে, কারণ এর পেছনে প্রকৃত সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ পাচ্ছে।
কৃষি: ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড
শিবরাজ সিং চৌহান বলেছেন, “কৃষি হলো ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড এবং কৃষকরা এর আত্মা। প্রায় ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে। কৃষি শক্তিশালী ছাড়া ভারতের উন্নয়ন অসম্ভব।” তিনি অতীত দশকের উন্নতি উল্লেখ করে জানিয়েছেন, গত দশ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩,৩০৯ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছেছে। তিনি দুগ্ধ উৎপাদনের উল্লেখও করেছেন, যা ১৯৬৬-৮০ থেকে বার্ষিক ০.৯ মিলিয়ন টন থেকে ২০১৪-২৪ এ ১০.২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের পরিচয় দেয়।
নতুন প্রযুক্তি ও প্রকল্প
মন্ত্রী জানিয়েছেন, ক্যাবিনেট সম্প্রতি ‘প্রধানমন্ত্রী ধান-ধান্য যোজনা’কে অনুমোদন করেছে, যা ২০২৫-২৬ থেকে ছয় বছর ধরে ১০০ জেলায় কার্যকর হবে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য সেচ ব্যবস্থা, সঞ্চয়াগার এবং কৃষকদের ক্রেডিট অ্যাক্সেস উন্নত করা, যা তাদের স্বাবলম্বী করবে। তিনি জিনোম সম্পাদিত ধানের নতুন জাত কমলা এবং ডিএসটি রাইস-১-এর কথা উল্লেখ করেছেন, যা ফসল উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ বাড়িয়ে পানির ব্যবহার কমিয়েছে এবং উৎপাদন খরচ হ্রাস করেছে। এই বীজগুলো কৃষকরা পুনরায় ব্যবহার করতে পারবেন, তবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য প্রতি তিন বছরে বীজ পরিবর্তন করা উচিত।
স্থানীয় চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
তিনি রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের প্রভাব উল্লেখ করে বলেছেন, এটি মাটির স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই সরকার প্রাকৃতিক কৃষি মিশন চালু করেছে, যা এক কোটি কৃষকের কাছে পৌঁছাতে চায়। এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও বায়ো-সম্পদ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে, যা বর্তমানে ১৮ লাখ কৃষক এবং ৭.৫ লাখ হেক্টর জমি আবরণ করবে। অধিক মাটির উপলব্ধতা কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি হাইড্রোপনিক্স, বাগানবাড়ি এবং জৈব কৃষির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। জাতীয় বাগানকলা মিশনের অধীনে পলিহাউস ও গ্রিনহাউসের জন্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে, যার ফলে কিছু এলাকায় কৃষকরা প্রতি একরে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় করছেন।
রপ্তানি ও আয় বৃদ্ধি
ভারত বর্তমানে ৫০,০০০ কোটি টাকা মূল্যের বাসমতি চাল এবং বিভিন্ন কৃষি পণ্য রপ্তানি করছে। চৌহান বলেছেন, “আমরা একসময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পি-এল-৪৮০-এর অধীনে লাল গম আমদানি করতাম, আজ আমরা অতিরিক্ত খাদ্য রপ্তানি করছি।” তিনি ‘লক্ষপতি দিদি’ উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন, যার লক্ষ্য গ্রামীণ নারীদের বার্ষিক আয় ১ লাখ টাকা করা। এর মাধ্যমে ১.৫ কোটি নারী ইতিমধ্যে লক্ষপতি দিদি হয়েছেন, এবং এবার ‘মিলেনিয়াম দিদি’ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে, যার আয় ১০ লাখ টাকা হবে।
কৃষকদের সুরক্ষা ও আগামী পরিকল্পনা
মন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার ১৯৬০-এর পুরনো নিয়মের পরিবর্তে নতুন আইন প্রস্তুত করছে, যা নিম্নমানের বীজ, সার বা কীটনাশক বিক্রির জন্য কঠোর জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রাখবে। গোটা-মশলা ও তেলের আমদানি কমানোর জন্য দুটি মিশন চালু হয়েছে, যার মাধ্যমে উন্নত বীজ কিট ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। পাম তেল মিশন ২০২৭-এর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এছাড়া, সরকার রাজ্যভিত্তিক পাঁচ বছরের ফসল-নির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করছে, যেমন ইন্দোরে সোয়াবিন এবং কোয়িম্বতোরে তুলার জন্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
যদিও এই পরিকল্পনা উচ্ছ্বসিত, তবুও কৃষকদের মধ্যে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পাঞ্জাবে কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গে চৌহান বলেছেন, কৃষি রাজ্যের বিষয় হলেও কেন্দ্র আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিল। তিনি এমএসপি বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন, যেমন গমের মূল্য ২০১৩-১৪ থেকে ১,৪০০ টাকা থেকে ২,৪২৫ টাকা এবং ধানের ১,৩১০ থেকে ২,৩৬৯ টাকা হয়েছে। তবে, কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, এই বৃদ্ধি কৃষকদের সব সমস্যা সমাধান করতে পারেনি।
শিবরাজ সিং চৌহানের ‘বিকসিত কৃষি সঙ্কল্প অভিযান’ কৃষকদের জীবন রূপান্তরের লক্ষ্যে ২,১৭০ বিজ্ঞানী দল গ্রামে গিয়ে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এই পরিকল্পনা সফল হলে ভারত সত্যিই বিশ্বের ফুড বাস্কেট হতে পারে, তবে এর জন্য কৃষকদের সঙ্গে আরও গভীর সহযোগিতা ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন।