ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম গম উৎপাদক (Wheat Production) দেশ হিসেবে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গম উৎপাদনের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। ২০২৫ সালে ভারত তার উষ্ণতম ফেব্রুয়ারি রেকর্ড করেছে, যা গম ফসলের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, উষ্ণ আবহাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং জলের ঘাটতি গমের ফলন ৬% থেকে ২৫% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং ভারতের গম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অভিযোজন কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
গম একটি রবি ফসল, যা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বপন করা হয় এবং ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে কাটা হয়। এটি শীতল আবহাওয়া এবং পরিমিত আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণ তাপমাত্রা, অনিয়মিত মৌসুম এবং জলের ঘাটতি গম উৎপাদনের জন্য ব26% পর্যন্ত কমিয়ে যোগাওয়া যায়।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি: ২০২২ সালে ভারতের উষ্ণতম ফেব্রুয়ারি রেকর্ড করা হয়েছিল। উচ্চ তাপমাত্রা ফুলে যাওয়া এবং দ্রুত পাকা ফলন কমিয়ে দেয়।
- বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন: অনিয়মিত বৃষ্টিপাত গমের ফলন হ্রাস করে এবং জলের ঘাটতি আরও বাড়ায়।
- জলের ঘাটতি: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেচের জলের প্রাপ্যতা হ্রাস পায়।
- ফলন হ্রাস: বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গমের ফলন ৫.৫% হ্রাস পায়।
- রোগের প্রকোপ: উষ্ণ তাপমাত্রা গমের রোগের প্রকোপ বাড়ায়।
- ফসলের ক্ষতি: উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ফসলের ক্ষতি হয় এবং বাজারে মূল্য হ্রাস পায়।
অভিযোজন কৌশল
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কৃষকদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন কৌশল প্রয়োজন:
- তাপ-প্রতিরোধী জাত: তাপ-প্রতিরোধী গমের জাত বিকাশ করা, যা উচ্চ তাপমাত্রায় ভাল ফল দেয়।
- প্রাথমিক বপন: তাপমাত্রার চরম অবস্থায় ফসলের ক্ষতি কমাতে প্রাথমিক বপনের সময় নির্ধারণ করা।
- দক্ষ সেচ: ড্রিপ সেচ এবং অন্যান্য জল-সংরক্ষণ কৌশল ব্যবহার করা।
- ফসলের বৈচিত্র্যকরণ: গমের পাশাপাশি জলবায়ু-সহিষ্ণু ফসল যেমন জোয়ার বা মিলেট চাষ করা।
- উন্নত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ: বাস্তব-সময়ের আবহাওয়া পরামর্শ ব্যবস্থার উন্নতি।
- নীতি সমর্থন: কৃষকদের জন্য জলবায়ু-নির্দিষ্ট বীমা এবং ক্ষতিপূরণ স্কিম প্রসারিত করা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গে গম উৎপাদন প্রধানত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইন্দো-গাঙ্গেটিক সমভূমিতে ঘটে। তবে, রাজ্যের শাকসবজি চাষীরাও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, বর্ধমান এবং নদিয়ার মতো এলাকায় অত্যধিক গরম এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
- প্রকাশ ঝা, কৃষি জলবায়ুবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক, মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটি: “উচ্চ তাপমাত্রার কারণে গমের ফুল ফোটা এবং দ্রুত পাকা হয়, যা শস্য ভর্তি সময়কে কমিয়ে দেয়। এর ফলে শস্যের ওজন কমে এবং মিলিং গুণমান নষ্ট হয়।”
- নিখিল গোভিয়াস, এনভায়রনমেন্টাল ডিফেন্স ফান্ড: “কম ফলন কৃষকদের সার, ছত্রাকনাশক ইত্যাদির অতিরিক্ত ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।”
- সন্দীপ মাহাতো, এম এস স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্ডেশন: “জলবায়ু পরিবর্তন যখন ফসলের বৃদ্ধির মৌলিক পর্যায়ে আঘাত করে তখন এটি আমাদের কৃষকদের জন্য গুরুতর সমস্যা।”
- ডিয়েগো পেকুয়েনো, CIMMYT: “জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাপ সহনশীলতা এবং প্রাথমিক বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য সহ গমের জাতগুলি উন্নত করা প্রয়োজন।”
চ্যালেঞ্জ
- উচ্চ তাপমাত্রা: গমের জন্য সর্বোত্তম তাপমাত্রা ১৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু ভারতের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির উপরে উঠে যাওয়ায় ফলন কমে।
- জলের ঘাটতি: অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং ভূগর্ভস্থ জলের হ্রাস সেচের সমস্যা সৃষ্টি করে।
- রোগের প্রকোপ: উষ্ণ তাপমাত্রা গমের রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, যেমন রুট রট এবং মাইলডিউ।
- মাটির অবক্ষয়: গ্রিন রেভল্যুশনের কারণে মাটির পুষ্টি হ্রাস পেয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ভারতের গম উৎপাদনের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন এবং জলের ঘাটতি গমের ফলন এবং গুণমানকে হ্রাস করছে। তবে, তাপ-প্রতিরোধী জাত, প্রাথমিক বপন, এবং দক্ষ সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকরা এই প্রভাবগুলি মোকাবেলা করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে গম চাষ একটি প্রধান কৃষি কার্যকলাপ, সেখানে জলবায়ু-সহিষ্ণু কৌশলগুলি গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি নীতি সমর্থন এবং উন্নত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করা যেতে পারে।