জৈব কৃষি (Organic Farming) ভারতের কৃষি খাতে একটি উদীয়মান প্রবণতা হয়ে উঠেছে, যা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে প্রতিফলিত করে। জৈব সার্টিফিকেশন এই প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা জৈব পণ্যের গুণমান এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করে।
ভারতে জৈব সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া, এর সুবিধা এবং জৈব বাজারের ক্রমবর্ধমান মূল্য কৃষক, ভোক্তা এবং অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। ভারত সরকার এই খাতকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা জৈব কৃষিকে গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করছে।
জৈব সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া
ভারতে জৈব সার্টিফিকেশন একটি কঠোর এবং নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া, যা কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এপিইডিএ) এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। জৈব সার্টিফিকেশনের জন্য ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর অর্গানিক প্রোডাকশন (এনপিওপি) এবং পার্টিসিপেটরি গ্যারান্টি সিস্টেম (পিজিএস-ইন্ডিয়া) নামে দুটি প্রধান প্রক্রিয়া রয়েছে।
এনপিওপি প্রধানত রপ্তানি-ভিত্তিক জৈব পণ্যের জন্য, এবং পিজিএস দেশীয় বাজারের জন্য কৃষকদের জৈব পণ্য সার্টিফিকেশনের সুবিধা দেয়।জৈব সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ার ধাপগুলি হল।
আবেদন
কৃষক বা উৎপাদককে এপিইডিএ-অনুমোদিত সার্টিফিকেশন সংস্থার কাছে আবেদন করতে হয়। এর জন্য জমির বিবরণ, ফসলের ধরন এবং কৃষি পদ্ধতির তথ্য প্রদান করতে হয়।
পরিদর্শন
সার্টিফিকেশন সংস্থা খামারে পরিদর্শন করে এবং মাটি, জল, ফসল এবং কৃষি পদ্ধতি পরীক্ষা করে। এই পরিদর্শনে রাসায়নিক কীটনাশক বা সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ কিনা তা যাচাই করা হয়।
রূপান্তর পর্যায়
জৈব কৃষিতে রূপান্তরের জন্য সাধারণত ২-৩ বছর সময় লাগে, যেখানে কৃষককে রাসায়নিক ইনপুট ব্যবহার বন্ধ করতে হয়। এই সময়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।
সার্টিফিকেশন
পরিদর্শন এবং পরীক্ষার পর সার্টিফিকেশন সংস্থা জৈব সার্টিফিকেট প্রদান করে, যা পণ্যের প্যাকেজিংয়ে ‘ইন্ডিয়া অর্গানিক’ লোগো ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
বার্ষিক নবায়ন
সার্টিফিকেশন বজায় রাখতে প্রতি বছর পরিদর্শন এবং নথিপত্র নবায়ন করতে হয়।পিজিএস-ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে, কৃষকদের ছোট দলগুলি নিজেদের মধ্যে পরিদর্শন করে এবং জৈব কৃষি মানদণ্ড মেনে চলার নিশ্চয়তা দেয়, যা ছোট কৃষকদের জন্য ব্যয়বহুল সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ার একটি সাশ্রয়ী বিকল্প।
জৈব সার্টিফিকেশনের সুবিধা
জৈব সার্টিফিকেশন কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ের জন্য একাধিক সুবিধা প্রদান করে। প্রথমত, এটি জৈব পণ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করে, যা ভোক্তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। কৃষকদের জন্য, সার্টিফাইড জৈব পণ্য উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়, যা তাদের আয় বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, জৈব ধান বা সবজির দাম প্রচলিত পণ্যের তুলনায় ২০-৫০% বেশি হতে পারে।
এছাড়া, জৈব কৃষি মাটির উর্বরতা বজায় রাখে, জলের ব্যবহার কমায় এবং পরিবেশের উপর কম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ভোক্তারা রাসায়নিকমুক্ত খাদ্য গ্রহণ করে স্বাস্থ্য সুবিধা পান। রপ্তানি বাজারে জৈব সার্টিফিকেশন ভারতীয় কৃষকদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ দেয়।
কী কারণে আসতে পারে আয়কর নোটিস? জেনে রাখুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
জৈব বাজারের বৃদ্ধি
ভারতের জৈব বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে ভারতের জৈব খাদ্য বাজারের মূল্য ছিল প্রায় ১০০০ কোটি টাকা, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৩০০০ কোটি টাকায় পৌঁছবে বলে প্রত্যাশিত। বিশ্ববাজারে ভারতের জৈব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে।
ভারত বর্তমানে জৈব পণ্য রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে শীর্ষ দশে রয়েছে। সিকিম ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ জৈব রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এবং মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, এবং উত্তরাখণ্ড জৈব কৃষিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।পশ্চিমবঙ্গেও জৈব কৃষি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
দার্জিলিংয়ের জৈব চা এবং বর্ধমানের জৈব ধান আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ স্থান পেয়েছে। রাজ্য সরকার জৈব কৃষি প্রচারে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে, যেমন কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং ভর্তুকি প্রদান। ভারত সরকার জৈব কৃষি ও সার্টিফিকেশন প্রচারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেমন
পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা (পিকেভিওয়াই): এই প্রকল্প জৈব কৃষি প্রচারে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ প্রদান করে। এটি ২০১৫ সালে চালু হয় এবং বর্তমানে ১০ লক্ষ হেক্টর জমিকে জৈব কৃষির আওতায় আনা হয়েছে।
মিশন অর্গানিক ভ্যালু চেইন ডেভেলপমেন্ট (এমওভিসিডি): উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য এই প্রকল্প জৈব পণ্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণনের জন্য পরিকাঠামো তৈরি করে।
জৈব সার্টিফিকেশন ভর্তুকি এপিইডিএ সার্টিফিকেশন খরচের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে, যা ছোট কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী করে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জৈব সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ছোট কৃষকদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ। এছাড়া, জৈব পণ্যের বিপণন এবং সচেতনতার অভাবও একটি বাধা। তবে, সরকারের উদ্যোগ এবং ক্রমবর্ধমান ভোক্তা চাহিদা এই খাতের সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের জৈব বাজার বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে পৌঁছতে পারে।
জৈব সার্টিফিকেশন ভারতের কৃষি খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণ এবং ভোক্তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারত
সরকারের পদক্ষেপ এবং জৈব বাজারের দ্রুত বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলি এই সুযোগ গ্রহণ করে জৈব কৃষিকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। আগামী দিনে জৈব সার্টিফিকেশন ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।