গঙ্গা নদী ভারতের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রাণস্বরূপ, তিনি আজ দূষণের কবলে (Ganga River Pollution) জর্জরিত। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য এই দূষণ কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং তাদের জীবিকা ও ফসল উৎপাদনের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। গঙ্গার জলের দূষণ মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে এবং ফসলের উৎপাদন হ্রাস করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা গঙ্গা নদীর দূষণের কারণ, এর কৃষির উপর প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
গঙ্গা নদীর দূষণের কারণ
গঙ্গা নদীর দূষণের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। শিল্প বর্জ্য, পৌর বর্জ্য, কৃষি রাসায়নিক এবং ধর্মীয় কার্যকলাপ থেকে উৎপন্ন বর্জ্য নদীর জলে মিশে যাচ্ছে। শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত ভারী ধাতু, যেমন সিসা, পারদ এবং ক্যাডমিয়াম, গঙ্গার জলকে বিষাক্ত করে তুলছে। এছাড়া, কৃষি কার্যকলাপে ব্যবহৃত কীটনাশক এবং সার নদীর জলে প্রবাহিত হয়ে দূষণ বাড়াচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি এবং নদিয়ার মতো জেলাগুলিতে গঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় এই দূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান।
এছাড়া, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং অপরিশোধিত নর্দমা নদীর জলের গুণগত মানকে আরও খারাপ করছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গঙ্গায় প্রতিদিন প্রায় ১২০০ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত নর্দমা নির্গত হচ্ছে। এই দূষিত জল যখন কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়, তখন তা মাটি এবং ফসলের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
মাটির উপর প্রভাব
গঙ্গার দূষিত জল সেচের জন্য ব্যবহার করা হলে তা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। ভারী ধাতু এবং রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে জমা হয়ে মাটির প্রাকৃতিক গঠন এবং জৈব উপাদানের ভারসাম্য নষ্ট করে। এই দূষণ মাটির অণুজীবের কার্যকলাপ হ্রাস করে, যা মাটির উর্বরতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদের কৃষকরা জানিয়েছেন যে, তাদের জমির মাটি ধীরে ধীরে কম উৎপাদনশীল হয়ে উঠছে।
মাটিতে জমা হওয়া ভারী ধাতুগুলি ফসলের মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। এছাড়া, দূষিত জলের কারণে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ফসলের বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। কৃষকরা লক্ষ্য করেছেন যে, তাদের জমিতে ধান, গম এবং শাকসবজির ফলন ক্রমাগত কমছে।
ফসলের উপর প্রভাব
গঙ্গার দূষিত জল সরাসরি ফসলের উৎপাদনশীলতার উপর প্রভাব ফেলছে। দূষিত জলের মাধ্যমে সেচ করা ফসল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফলন কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা তীরবর্তী এলাকায় ধানের ফলন গত দশকে ১৫-২৫% কমেছে। এছাড়া, ফসলে ভারী ধাতু এবং বিষাক্ত পদার্থ জমা হওয়ার ফলে ফসলের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। এই ফসল বাজারে কম দামে বিক্রি হয়, যা কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এছাড়া, দূষিত জলের কারণে ফসলে রোগ এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ বাড়ছে। কৃষকরা আরও বেশি কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। ফলে, কৃষি কাজ আরও ব্যয়বহুল এবং কম লাভজনক হয়ে উঠছে।
কৃষকদের জীবিকার উপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য গঙ্গা নদী জীবনের প্রধান উৎস। কিন্তু নদীর দূষণ তাদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ফসলের ফলন কমে যাওয়ায় কৃষকদের আয় হ্রাস পাচ্ছে। অনেক কৃষক ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। এছাড়া, দূষিত ফসলের কারণে বাজারে তাদের পণ্যের চাহিদা কমছে, যা তাদের আর্থিক সংকট আরও গভীর করছে।
গঙ্গা তীরবর্তী গ্রামগুলিতে কৃষকরা জানিয়েছেন যে, তাদের জমির উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় তারা বিকল্প জীবিকার সন্ধান করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে কৃষি ছেড়ে শহরে শ্রমিকের কাজে যোগ দিচ্ছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সমাধানের উপায়
গঙ্গা নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষির উপর এর প্রভাব কমানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নিম্নে কিছু সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হলো:
১. শিল্প বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ: শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত বর্জ্য পরিশোধনের জন্য কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করা উচিত। বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন এবং এর সঠিক পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।
২. নর্দমা ব্যবস্থাপনা: পৌর এলাকায় অপরিশোধিত নর্দমা নদীতে নির্গত হওয়া বন্ধ করতে হবে। নর্দমা পরিশোধন প্ল্যান্টের সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৩. পরিবেশবান্ধব কৃষি: কৃষকদের পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি, যেমন জৈব সার এবং কম রাসায়নিক ব্যবহার, গ্রহণে উৎসাহিত করা উচিত। এটি মাটির দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।
৪. বিকল্প জলের উৎস: গঙ্গার দূষিত জলের পরিবর্তে বিকল্প জলের উৎস, যেমন বৃষ্টির জল সংরক্ষণ বা ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার, কৃষকদের জন্য উপলব্ধ করা উচিত।
৫. সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ: কৃষকদের মধ্যে দূষণের প্রভাব এবং এর প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ
ভারত সরকার গঙ্গা নদী পরিষ্কার করার জন্য ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর দূষণ কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে, এই প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করছে স্থানীয় সরকার এবং সম্প্রদায়ের সহযোগিতার উপর। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও গঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে, তবে আরও কঠোর পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন।
গঙ্গা নদীর দূষণ পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দূষণ কেবল মাটি ও ফসলের ক্ষতি করছে না, বরং কৃষকদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার, কৃষক এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি এবং নদী পরিষ্কারের উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা গঙ্গাকে তার পূর্বের গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারি এবং কৃষকদের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি।