পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজের ঘাটতি! পেঁয়াজ চাষিদের কীভাবে ধ্বংস করছে

পশ্চিমবঙ্গের পেঁয়াজ চাষিরা বর্তমানে একটি গুরুতর সংকটের মুখোমুখি। পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ (Cold Storage) সুবিধার অভাবে তাঁদের ফসলের উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হচ্ছে, যার ফলে তাঁরা কম…

How Cold Storage Shortage Is Devastating Onion Farmers in West Bengal

পশ্চিমবঙ্গের পেঁয়াজ চাষিরা বর্তমানে একটি গুরুতর সংকটের মুখোমুখি। পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ (Cold Storage) সুবিধার অভাবে তাঁদের ফসলের উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হচ্ছে, যার ফলে তাঁরা কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। পেঁয়াজ ভারতীয় রান্নাঘরের একটি অপরিহার্য উপাদান এবং পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নগদ ফসল। তবে, কোল্ড স্টোরেজের অপর্যাপ্ততা এই চাষিদের জীবিকা এবং রাজ্যের পেঁয়াজ বাজারের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজ সংকট, ফসল ফলনোত্তর ক্ষতি এবং এর সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব।

পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজ সংকট
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্যতম প্রধান কৃষি রাজ্য, যেখানে মুর্শিদাবাদ, নদীয়া এবং হুগলির মতো জেলাগুলো পেঁয়াজ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, রাজ্যের কোল্ড স্টোরেজ অবকাঠামো এই চাহিদা পূরণে সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত। সূত্র অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের কোল্ড স্টোরেজ সুবিধাগুলো প্রধানত আলুর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। রাজ্যে বছরে প্রায় ১১৫ লক্ষ টন আলু উৎপাদিত হয়, কিন্তু কোল্ড স্টোরেজ ক্ষমতা মাত্র ৭০ লক্ষ টন। পেঁয়াজের জন্য, যার জন্য ৫৫-৬৫% আপেক্ষিক আর্দ্রতা (RH) এবং ০-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিশেষায়িত স্টোরেজ প্রয়োজন, পরিস্থিতি আরও জটিল। রাজ্যে পেঁয়াজের জন্য নিবেদিত কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে, চাষিরা ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিকভাবে বায়ুচলাচলযুক্ত কাঠামো বা অস্থায়ী শেডে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে বাধ্য হন, যা উল্লেখযোগ্য ক্ষতির কারণ হয়।

   

পেঁয়াজ একটি আধা-নশ্বর ফসল, যার ফলে সংরক্ষণের সময় ৩০-৪০% ফসল নষ্ট হয়ে যায়। অস্বাভাবিক বৃষ্টি বা উচ্চ আর্দ্রতার সময় এই ক্ষতি ৪০% ছাড়িয়ে যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে রবি মরসুমে উৎপাদিত পেঁয়াজ, যা মার্চ থেকে জুন মাসে বাজারে আসে, খরিফ ফসল (অক্টোবর-নভেম্বর) না আসা পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজের অভাবে চাষিরা ফসল ফলনের পরপরই তা বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হন, প্রায়ই কুইন্টাল প্রতি ৩০০-৫০০ টাকার মতো কম দামে, যেখানে উৎপাদন খরচই ১,২০০-১,৩০০ টাকা।

ফসল ফলনোত্তর ক্ষতি: একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা
ভারত জুড়ে পেঁয়াজের ফসল ফলনোত্তর ক্ষতি ৩০-৪০% বলে অনুমান করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে চাষিরা প্রায়ই পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কম খরচের বাঁশের তৈরি ছাউনি বা নীচে এবং পাশে বায়ুচলাচলযুক্ত শেড ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিগুলো তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর, যার ফলে চার মাসে ৪২-৪৬% পর্যন্ত ফসল নষ্ট হয়। ছত্রাক সংক্রমণ, যেমন ব্ল্যাক মোল্ড, এবং অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও তাপ ফসলের ক্ষতি ত্বরান্বিত করে। উদাহরণস্বরূপ, হুগলির চিনসুরার একটি চাষি পরিবার জানিয়েছে, তারা তাদের ফসলের একটি অংশ বাজারে পাঠায় এবং কিছু অংশ বাড়িতে ব্যবহারের জন্য রাখে। বাকি ফসল স্থানীয় কোল্ড স্টোরেজে রাখার চেষ্টা করলেও, স্থানের অভাবে বেশিরভাগ ফসলই নষ্ট হয়ে যায়।

এছাড়া, ফসল ফলনের সময় বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে দাম কমে যায়, যার ফলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ২০২৩ সালে মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজের দাম কুইন্টাল প্রতি ৩০০-৫০০ টাকায় নেমে গিয়েছিল, এবং পশ্চিমবঙ্গের চাষিরাও একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। এই দাম পড়ে যাওয়া কেবল আর্থিক ক্ষতিই নয়, বরং চাষিদের পেঁয়াজ চাষ সম্প্রসারণে নিরুৎসাহিত করে, যা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন কমায় এবং আমদানির উপর নির্ভরতা বাড়ায়।

চাষিদের উপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
কোল্ড স্টোরেজের ঘাটতি পশ্চিমবঙ্গের পেঁয়াজ চাষিদের উপর গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলছে। অনেক চাষি কৃষি ঋণের বোঝায় জর্জরিত, এবং তারা ঋণ পরিশোধের জন্য ফসল ফলনের পরপরই তা বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে তারা বাজারে ভালো দামের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন না। রাজ্য সরকার কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া টন প্রতি ১৩৬-১৫২ টাকায় নির্ধারণ করেছে, যা বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য খুবই কম। ফলে, নতুন কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। প্রতি টন ক্ষমতার জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ ৮,০০০ টাকা এবং মরসুম প্রতি পরিচালন খরচ ১,২৫০ টাকা হওয়ায় বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই খাতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

Advertisements

এছাড়া, ব্যবসায়ী এবং মধ্যস্থতাকারীরা প্রায়ই আগাম কোল্ড স্টোরেজ স্লট বুক করে ফেলেন, যার ফলে ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ জমা করে রেখে দাম বাড়ার সময় বাজারে ছাড়েন, যা তাদের জন্য মোটা মুনাফা নিয়ে আসে, কিন্তু চাষিরা কম দামে বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিছু ক্ষেত্রে, মহারাষ্ট্রে ২০২৩ সালে দেখা গিয়েছিল, চাষিরা প্রতিবাদে তাদের ফসল পুড়িয়ে ফেলেছেন, যা এই সংকটের তীব্রতা প্রকাশ করে।

সমাধানের পথ
এই সংকট মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ এবং চাষি সংগঠনগুলো বেশ কিছু সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত পেঁয়াজের জন্য নিবেদিত, আর্দ্রতা-নিয়ন্ত্রিত কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা নির্মাণে বিনিয়োগ করা। ২০২০ সালে মুর্শিদাবাদে ৫০,০০০ টন ক্ষমতার একটি সুবিধা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা ইতালীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারত। তবে, এই প্রকল্পের অগ্রগতি ধীর, এবং চাষিরা এখনও সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীদের জমা করার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ফিলিপিন্সের মতো চাষি সমবায় গঠন করে চাষিদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া, আইসিএআর-ডিরেক্টরেট অন অনিয়ন অ্যান্ড গার্লিক রিসার্চের প্রস্তাবিত কম খরচের, বিকেন্দ্রীকৃত কোল্ড স্টোরেজ ইউনিটের জন্য ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। এই ইউনিটগুলো ২৭ ± ২° সেলসিয়াস এবং ৬০-৬৫% আর্দ্রতায় ফসলের ক্ষতি ২%-এ নামিয়ে আনতে পারে।

অবশেষে, বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচারের প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু গামা ইরেডিয়েশন সেন্টারের মতো ইরেডিয়েশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেঁয়াজের শেলফ লাইফ ৩-৪ মাস বাড়ানো যেতে পারে। চাষিদের ফসল ফলন এবং সংরক্ষণ কৌশল, যেমন সুষম সার প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রিত সেচের প্রশিক্ষণ দেওয়াও ক্ষতি কমাতে সাহায্য করবে।

পথপ্রদর্শন
পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজের ঘাটতি একটি পদ্ধতিগত সমস্যা, যা অবিলম্বে সমাধানের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত অবকাঠামো ছাড়া পেঁয়াজ চাষিরা ক্রমাগত ক্ষতি, কম দাম এবং আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হবেন। রাজ্য সরকারের উচিত পশ্চিমবঙ্গ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সহযোগিতায় চাষিদের জন্য নিবেদিত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, ভাড়ার হার সংশোধন এবং ব্যবসায়ীদের শোষণমূলক কার্যকলাপ রোধে নীতি প্রণয়ন করা। এই পদক্ষেপগুলো পশ্চিমবঙ্গের পেঁয়াজ চাষিদের ক্ষমতায়ন করবে, বাজারের দাম স্থিতিশীল করবে এবং পেঁয়াজ আমদানির উপর নির্ভরতা কমাবে। এখনই সময় এই সংকট মোকাবিলার, যাতে কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড চাষিরা পদ্ধতিগত ব্যর্থতার শিকার না হন।