নির্ভুল কৃষি! ড্রোন ও সেন্সর ব্যবহারে কীভাবে এক কৃষকের দ্বিগুণ আয়

কৃষি জগতে নির্ভুল কৃষি (Precision Agriculture) এখন একটি বিপ্লব ঘটাচ্ছে। ড্রোন, সেন্সর, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরা তাঁদের ফসলের উৎপাদন…

West Bengal Farmers Embrace Drone Technology in 2025 for Smarter Agriculture

কৃষি জগতে নির্ভুল কৃষি (Precision Agriculture) এখন একটি বিপ্লব ঘটাচ্ছে। ড্রোন, সেন্সর, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরা তাঁদের ফসলের উৎপাদন বাড়াচ্ছেন, খরচ কমাচ্ছেন এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে টেকসই কৃষি চর্চা করছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা কলকাতার কাছাকাছি এক গ্রামের কৃষক রমেশ মণ্ডলের গল্প তুলে ধরব, যিনি ড্রোন এবং সেন্সর ব্যবহার করে নির্ভুল কৃষির মাধ্যমে তাঁর আয় দ্বিগুণ করেছেন। তাঁর এই সাফল্যের গল্প কৃষকদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা এবং ভবিষ্যৎ কৃষির দিকনির্দেশনা।

নির্ভুল কৃষি কী?
নির্ভুল কৃষি হলো এমন একটি কৃষি পদ্ধতি, যেখানে উন্নত প্রযুক্তি যেমন ড্রোন, সেন্সর, জিপিএস, এবং ডেটা বিশ্লেষণ ব্যবহার করে ফসলের যত্ন, জলসেচন, এবং সার প্রয়োগের মতো কাজগুলি আরও দক্ষতার সাথে করা হয়। এই পদ্ধতি কৃষকদের ফসলের স্বাস্থ্য, মাটির অবস্থা, এবং আবহাওয়ার তথ্য রিয়েল-টাইমে সংগ্রহ করতে সাহায্য করে, যা তাঁদের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে। নির্ভুল কৃষি ঐতিহ্যবাহী কৃষির তুলনায় সম্পদের অপচয় কমায় এবং ফলন বাড়ায়।

   

রমেশ মণ্ডলের গল্প
রমেশ মণ্ডল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি ছোট গ্রামের একজন কৃষক। তাঁর ৫ একর জমিতে তিনি ধান, সবজি, এবং আলু চাষ করতেন। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে চাষের কারণে তিনি প্রায়ই অতিরিক্ত সার ও জলের অপচয়, ফসলের রোগ, এবং কম ফলনের সমস্যায় পড়তেন। তাঁর আয় ছিল সীমিত, এবং পরিবারের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।
২০২৩ সালে রমেশ একটি স্থানীয় কৃষি সম্মেলনে নির্ভুল কৃষি সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি ড্রোন এবং সেন্সর প্রযুক্তির সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হন এবং সিদ্ধান্ত নেন এটি তাঁর জমিতে প্রয়োগ করবেন। তিনি একটি কৃষি প্রযুক্তি স্টার্টআপের সাথে যোগাযোগ করেন, যারা তাঁকে ড্রোন এবং সেন্সর-ভিত্তিক সমাধান সরবরাহ করে।

ড্রোন এবং সেন্সরের ব্যবহার
রমেশ তাঁর জমিতে নিম্নলিখিত প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছেন:
১. ড্রোন-ভিত্তিক ফসল পর্যবেক্ষণ: রমেশের জমিতে মাল্টিস্পেকট্রাল ক্যামেরা সহ ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এই ড্রোনগুলি ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করে এবং পুষ্টির ঘাটতি, পানির অভাব, বা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করে। ড্রোনের সংগৃহীত ডেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়, যা রমেশকে ফসলের সমস্যাগুলি দ্রুত চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, ড্রোনের মাধ্যমে তিনি শিখেছিলেন যে তাঁর ধানের জমির একটি অংশে পানির অভাব রয়েছে, যা তিনি আগে লক্ষ্য করেননি।

২. মাটি ও আবহাওয়া সেন্সর: রমেশ জমিতে IoT-ভিত্তিক সেন্সর স্থাপন করেছেন, যা মাটির আর্দ্রতা, পিএইচ, এবং পুষ্টি মাত্রা পরিমাপ করে। এই সেন্সরগুলি রিয়েল-টাইমে ডেটা সরবরাহ করে, যা একটি ক্লাউড-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে বিশ্লেষণ করা হয়। এর ফলে তিনি জলসেচন এবং সার প্রয়োগে নির্ভুলতা আনতে পেরেছেন, যা পানি এবং সারের অপচয় ৩০% কমিয়েছে।

৩. নির্ভুল স্প্রে ও বীজ বপন: ড্রোন ব্যবহার করে রমেশ এখন কীটনাশক এবং সার স্প্রে করেন। এই ড্রোনগুলি শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় এলাকায় স্প্রে করে, যার ফলে রাসায়নিকের ব্যবহার ৪০% ক homemade মেছে। এছাড়া, ড্রোন-ভিত্তিক বীজ বপন তাঁর সময় এবং শ্রম বাঁচিয়েছে।

৪. ফলন ভবিষ্যদ্বাণী: ড্রোন এবং সেন্সর থেকে সংগৃহীত ডেটা AI-এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ফলনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। এটি রমেশকে বাজারে ফসল বিক্রির জন্য পরিকল্পনা করতে সাহায্য করেছে, যার ফলে তিনি ভালো দাম পেয়েছেন।

Advertisements

ফলাফল
নির্ভুল কৃষি প্রয়োগের প্রথম বছরেই রমেশ তাঁর ফলন ২৫% বাড়িয়েছেন। তিনি ধান এবং সবজির উৎপাদন বাড়িয়ে বাজারে ভালো দামে বিক্রি করেছেন। পানি এবং সারের অপচয় কমার ফলে তাঁর উৎপাদন খরচও কমেছে। ফলস্বরূপ, তাঁর আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া, তিনি এখন তাঁর জমির পরিবেশগত প্রভাব কমাতে সক্ষম হয়েছেন, যা টেকসই কৃষির একটি বড় পদক্ষেপ।

রমেশ বলেন, “আগে আমি জানতাম না আমার জমির কোন অংশে কী সমস্যা। ড্রোন এবং সেন্সর আমাকে সবকিছু পরিষ্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। এখন আমি ঠিক জায়গায় ঠিক পরিমাণে সার এবং পানি দিই, যা আমার খরচ কমিয়েছে এবং ফসল বাড়িয়েছে।”

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
নির্ভুল কৃষি প্রয়োগের পথে রমেশের কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রাথমিক বিনিয়োগ খরচ বেশি ছিল, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। তবে, স্থানীয় কৃষি স্টার্টআপ এবং সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে তিনি এই বিনিয়োগ বহন করতে পেরেছেন। এছাড়া, তিনি একটি “ড্রোন-এজ-এ-সার্ভিস” (Drone-as-a-Service) মডেল ব্যবহার করেছেন, যেখানে তিনি ড্রোন কিনে না রেখে ভাড়া নিয়েছেন। প্রশিক্ষণের জন্য তিনি স্টার্টআপের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন, যা তাঁকে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
রমেশের সাফল্য অন্যান্য কৃষকদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কৃষি স্টার্টআপগুলি এখন নির্ভুল কৃষিকে ছোট কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছে। ড্রোন এবং সেন্সরের দাম কমার সাথে সাথে এই প্রযুক্তি আরও সাশ্রয়ী হচ্ছে। এছাড়া, ৫জি নেটওয়ার্ক এবং উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একীকরণ নির্ভুল কৃষিকে আরও দক্ষ করবে।

নির্ভুল কৃষির মাধ্যমে কৃষকরা কেবল আয় বাড়াচ্ছেন না, বরং জলবায়ু পরিবর্তন এবং সম্পদের অভাবের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও সক্ষম হচ্ছেন। রমেশের মতো কৃষকদের গল্প প্রমাণ করে যে প্রযুক্তি কৃষিকে আরও লাভজনক এবং টেকসই করে তুলতে পারে।

রমেশ মণ্ডলের গল্প নির্ভুল কৃষির সম্ভাবনার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ড্রোন, সেন্সর, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তিনি তাঁর আয় দ্বিগুণ করেছেন এবং তাঁর জমির উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছেন। এই প্রযুক্তি কলকাতার কাছাকাছি গ্রামীণ কৃষকদের জন্য একটি নতুন পথ দেখাচ্ছে। সরকারি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্ভুল কৃষি ভারতের কৃষি খাতকে রূপান্তরিত করতে পারে। রমেশের সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তি এবং কৃষির সঠিক সমন্বয় কৃষকদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে।