সরকারী প্রকল্পে কৃষি পর্যটনের ছোঁয়া, খুলছে উন্নয়নের দরজা

কৃষি পর্যটন বা অ্যাগ্রিট্যুরিজম (Agri Tourism) ভারতের কৃষকদের জন্য একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় আয়ের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই উদ্ভাবনী ধারণাটি কৃষি এবং পর্যটনের সমন্বয়ে…

Agri Tourism in India

কৃষি পর্যটন বা অ্যাগ্রিট্যুরিজম (Agri Tourism) ভারতের কৃষকদের জন্য একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় আয়ের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই উদ্ভাবনী ধারণাটি কৃষি এবং পর্যটনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে, যা কৃষকদের তাদের খামারে পর্যটকদের আকর্ষণ করে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ করে দেয়। শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে এবং গ্রামীণ জীবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা এখন ক্রমশ কৃষি পর্যটনের দিকে ঝুঁকছেন।

এই প্রক্রিয়ায় কৃষকরা তাদের ফসল, গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য পর্যটকদের সামনে তুলে ধরে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ভারত সরকারও এই সম্ভাবনাময় খাতকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

   

কৃষি পর্যটন কী?

কৃষি পর্যটন হল এমন একটি পর্যটন মডেল, যেখানে পর্যটকরা খামারে এসে কৃষি কার্যক্রমে অংশ নেন, গ্রামীণ জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে খামার পরিদর্শন, ফসল কাটা, পশুপালন, গ্রামীণ খেলাধুলা, ঐতিহ্যবাহী রান্নার ক্লাস, এবং ফার্ম স্টে বা খামারে থাকার সুবিধা।

ভারতে এই ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয় হয় মহারাষ্ট্রের বারামতিতে, যেখানে ২০০৪ সালে পান্ডুরঙ্গ তাওয়ারে অ্যাগ্রি ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এটিডিসি) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভারতের কৃষি পর্যটনের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। এটিডিসি’র উদ্যোগে মহারাষ্ট্রে এখন ৬০০টিরও বেশি কৃষি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে গত তিন বছরে প্রায় ২১ লক্ষ পর্যটক ভ্রমণ করেছেন এবং কৃষকরা ৫০ কোটি টাকার বেশি আয় করেছেন।

কৃষি পর্যটনের সুবিধা

কৃষি পর্যটন কৃষকদের জন্য একটি বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। ভারতের কৃষকরা প্রায়ই ফসলের দামের অস্থিরতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হন। কৃষি পর্যটন তাদের খামারে পর্যটকদের আকর্ষণ করে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে। এটি গ্রামীণ যুবকদের শহরে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা কমায় এবং তাদের কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

পর্যটকরা খামার থেকে সরাসরি জৈব পণ্য কিনতে পারেন, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক। এছাড়া, এই পর্যটন মডেল গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প এবং খাদ্য সংরক্ষণে সহায়তা করে। পর্যটকরা গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা তাদের মানসিক শান্তি প্রদান করে।

ভারত সরকারের পদক্ষেপ

ভারত সরকার কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে এই খাতকে উৎসাহিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২২ সালে পর্যটন মন্ত্রণালয় ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রমোশন অফ রুরাল হোমস্টেস’ চালু করে, যা ‘আত্মনির্ভর ভারত’ উদ্যোগের অংশ। এই কৌশলের লক্ষ্য গ্রামীণ এলাকায় পর্যটকদের জন্য ফার্ম স্টে এবং হোমস্টে প্রচার করা, যাতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা যায়।

স্বদেশ দর্শন স্কিম

এই প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সার্কিটকে একটি থিম্যাটিক সার্কিট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি গ্রামীণ এলাকায় পর্যটনের প্রচারে সহায়তা করে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। উদাহরণস্বরূপ, ছত্তিশগড়ের বস্তারে আদিবাসী কৃষি পর্যটন এবং গুজরাটের কচ্ছের বান্নি গ্রাসল্যান্ডে পশুপালন পর্যটন জনপ্রিয় হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী জনজাতীয় উন্নত গ্রাম অভিযান (পিএমজেউজিএ)

এই প্রকল্পের আওতায় আদিবাসী এলাকায় ১,০০০টি হোমস্টে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা কৃষি পর্যটনের সঙ্গে সমন্বিত। এটি গ্রামীণ জীবিকার উন্নতি ঘটাবে।

Advertisements

দেখো আমার দেশ স্কিম

এই স্কিম গ্রামীণ পর্যটনের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি দেশের অপ্রচলিত গন্তব্যগুলির প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ করে এবং কৃষকদের জন্য বাজার সৃষ্টি করে।

কৃষি অবকাঠামো তহবিল

এই তহবিল কৃষকদের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিপণন এবং প্রশিক্ষণে সহায়তা করে। কৃষি পর্যটন কেন্দ্রগুলির জন্য এই তহবিল ব্যবহার করে ফার্ম স্টে এবং অন্যান্য সুবিধা তৈরি করা যায়।

গ্লোবাল ফুড বাস্কেট হবে ভারত: কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী

রাজ্য সরকারের উদ্যোগ

মহারাষ্ট্র সরকার ২০২০ সালে একটি কৃষি পর্যটন নীতি প্রকাশ করে, যা গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন এবং পর্যটন খাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে। এই নীতির অধীনে কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা এবং বিপণন সুবিধা প্রদান করা হয়। কেরালার ‘সাসটেইনেবল, ট্যাঞ্জিবল, রেসপন্সিবল, এথনিক ট্যুরিজম’ (স্ট্রিট) প্রকল্পও গ্রামীণ পর্যটনের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্থানের ২০২২ সালের গ্রামীণ পর্যটন নীতি এবং মেঘালয়ের অ্যাগ্রো ট্যুরিজম ভিলা স্কিমও উল্লেখযোগ্য।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষি পর্যটন

পশ্চিমবঙ্গে কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনা অপার। দার্জিলিংয়ের তথাগত ফার্ম একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে পর্যটকরা চা বাগানে কাজ, গ্রামীণ হাঁটা, মাছ ধরা এবং ঐতিহ্যবাহী রান্নার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। রাজ্য সরকারও গ্রামীণ পর্যটনকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেমন হোমস্টে প্রকল্প এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে পর্যটন কার্যক্রমের সমন্বয়।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ

কৃষি পর্যটনের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন অবকাঠামোর অভাব, কৃষকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং বিপণনের সমস্যা। তবে, সরকারের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল এই সমস্যার সমাধানে সহায়তা করছে। ভারত সরকার ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে পর্যটনের ক্ষেত্রে বিশ্বনেতা করার লক্ষ্যে কাজ করছে, এবং কৃষি পর্যটন এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

কৃষি পর্যটন ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ। এটি কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি শহুরে পর্যটকদের গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ভারত সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন স্বদেশ দর্শন, পিএমজেউজিএ এবং কৃষি পরিকাঠামো তহবিল, এই খাতকে আরও শক্তিশালী করছে।

পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিও এই সুযোগ গ্রহণ করে গ্রামীণ পর্যটনের প্রচারে এগিয়ে আসছে। আগামী দিনে কৃষি পর্যটন ভারতের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।