২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪—কেন্দ্রীয় সরকার অ-বাসমতি সাদা ধানের রপ্তানির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা (Rice Export Policy) তুলে নিয়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গের ধান উৎপাদনকারী কৃষক ও রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে পারবোইল্ড ধানের রপ্তানি শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এই নীতি পরিবর্তনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে, বিশেষ করে খরিফ মরসুমের ফসলের আগমনের সঙ্গে। এই পদক্ষেপকে ‘গেম-চেঞ্জার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন রাজ্যের রপ্তানিকারক ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
Also Read | দেউলিয়াত্ব প্রক্রিয়ায় গতি আনতে লোকসভায় আইবিসি সংশোধনী বিল পেশ
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী রাজ্য, যা দেশের মোট ধান উৎপাদনের ১৫ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে। বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি এবং নদিয়ার মতো জেলাগুলি ধান চাষের জন্য বিখ্যাত। গত বছর ২০ জুলাই, ২০২৩ থেকে অ-বাসমতি সাদা ধানের রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ধানের সরবরাহ বাড়ানো এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে রাজ্যের প্রায় ৫০০-৬০০টি ধানের মিল বন্ধ হয়ে যায়, কারণ রপ্তানির চাহিদা কমে যাওয়ায় মিলগুলি লোকসানের মুখে পড়েছিল। বেঙ্গল রাইস মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুশীল কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, “এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় মিলগুলি পুনরায় চালু হবে এবং প্রতিটি মিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০০ জনের কর্মসংস্থান হবে।”
Also Read | প্রথমবার ITR ফাইলিং করছেন? জেনে নিন ১০টি সহজ উপায়
এই নীতি পরিবর্তন কৃষকদের জন্য উল্লেখযোগ্য সুবিধা নিয়ে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে গত বছর কৃষকরা ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের (এমএসপি) তুলনায় কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নতুন খরিফ ফসলের আগমনের সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় কৃষকরা এখন উচ্চতর মূল্যে তাদের ফসল বিক্রি করতে পারবেন। বর্ধমানের এক ধান ব্যবসায়ী সৌমেন কুন্ডু জানিয়েছেন, “এই পদক্ষেপের ফলে ব্যবসা দ্বিগুণ হবে। বর্ধমানে ৫০-৬০টি মিলে ‘গোবিন্দভোগ’ ধান প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, যা এখন আবার গতি পাবে।”
কেন্দ্রীয় সরকার অ-বাসমতি সাদা ধানের রপ্তানির জন্য প্রতি টন ৪৯০ মার্কিন ডলারের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য (এমইপি) নির্ধারণ করেছে। এই পদক্ষেপের ফলে ভারতের বিশাল ধানের মজুদ পরিচালনা করা সহজ হবে। ইন্ডিয়ান রাইস এক্সপোর্টার্স ফেডারেশনের সহ-সভাপতি দেব গর্গ জানিয়েছেন, “২০২৫ সালের ৩১শে মার্চের মধ্যে ধানের মজুদ ২৭৫ লক্ষ মেট্রিক টনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানি না খুললে সরকারের পক্ষে এই মজুদ সংরক্ষণ করা কঠিন হতো, এবং মজুদ ব্যয় বর্তমান ৪৫,০০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১,০৫,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছাত।”
Also Read | ডিএ বকেয়া নিয়ে বড় আপডেট, সংসদে কেন্দ্রের জবাব
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিপণন মন্ত্রী বেচারাম মান্না এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ডিভিসি’র অনিয়ন্ত্রিত জল নিষ্কাশনের কারণে রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলায় কৃষকরা বন্যার কবলে পড়েছিলেন। এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় কৃষকরা এখন উন্নত মূল্যে তাদের ফসল বিক্রি করতে পারবেন।” তবে, রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার ‘গোবিন্দভোগ’ এবং ‘তুলাইপাঞ্জি’র মতো রাজ্যের সুগন্ধি ধানের জিআই ট্যাগ সত্ত্বেও তাদের রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
রাইস ভিলা’র সিইও সুরজ আগরওয়াল বলেছেন, “অ-বাসমতি ধানের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত কৃষি খাতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি কৃষক ও রপ্তানিকারকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ভারতের কৃষি রপ্তানিকে ২০২৪-২৫ সালে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছাতে সহায়তা করবে।” হালদার গ্রুপের এমডি ও সিইও কেশব কুমার হালদার এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত কৃষকদের উচ্চতর আয়ের সুযোগ করে দেবে এবং রপ্তানি বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা বাড়াবে।”
এই নীতি পরিবর্তনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের ধান শিল্পে নতুন গতি আসবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলগুলি পুনরায় চালু হবে, এবং কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন। তবে, সুগন্ধি ধানের রপ্তানি নিয়ে রাজ্য সরকারের উদ্বেগ এবং কেন্দ্রের নীতির সমন্বয়ের অভাব নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আগামী মাসগুলিতে এই নীতির প্রভাব কৃষক ও রপ্তানিকারকদের আর্থিক অবস্থার উপর কীভাবে প্রতিফলিত হয়, তা দেখার বিষয়।